বাসস
  ১১ জুন ২০২৪, ২৩:২২

শিল্পকলায় ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী উৎসব অনুষ্ঠিত

ঢাকা, ১১ জুন, ২০২৪ (বাসস) : বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিল্পীদের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী উৎসব ২০২৪। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, পাংখোয়া, খাসিয়া, লুসাই, রাখাইন, গারো, হাজং, সাঁওতাল, ওঁরাও এবং মণিপুরী বাংলাদেশে বসবাসকারী ১৩টি সম্প্রদায়ের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন। 
আজ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সেলের ব্যবস্থাপনায় জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে তারা তাদের নিজ নিজ সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরিবেশন করেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে তাদের অংশগ্রহণে উদ্বোধনী নৃত্য পরিবেশিত হয়। মঙ্গল প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের মাধ্যমে মূল পর্বের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। 
শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন গবেষক সঞ্জীব দ্রং, বিশেষ অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি উপসচিব রাজীব কুমার সরকার।   
সাংস্কৃতিক পর্বের শুরুতেই কক্সবাজারের রাখাইন সম্প্রদায়ের ‘আর কে রাখাইন গ্রুপ’ দলনেতা ছেন ছেন ওয়ান রাখাইন এর নেতৃত্বে ‘প্রদীপ নৃত্য’ পরিবেশন করেন। রাখাইনদের কাছে প্রদীপ একটি শান্তির আলোক রশ্মি যা রাখাইনরা বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব বা প্রার্থনার কাজে মোমবাতি জ্বালিয়ে তা স্মরণ করে থাকে। এরপর ঢাকার চাকমা সম্প্রদায়ের ‘মনোঘর শিল্পী গোষ্ঠী’ শোভন দেওয়ান টিটুর নেতৃত্বে ‘চাকমাদের জীবনধারা’ তুলে ধরেন। মূলত পাবর্ত্য চট্টগ্রাম এবং বাংলাদেশের বিখ্যাত নদী গুলো নিয়ে একটি বন্ধুত্বের মেল বন্ধনের উপর ভিত্তি করে চাকমা আদিবাসীদের নদী কেন্দ্রিক যে জীবন ধারা তা এ নৃত্যটিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। রাঙ্গামাটির ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ‘রাঙ্গামাটি ত্রিপুরা কল্যাণ ফাউন্ডেশন’ শুক্লা ত্রিপুরার নেতৃত্বে পরিবেশন করেন ‘হজাগিরি নৃত্য’। হজাগিরি ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী মাঙ্গলিক নৃত্য,ত্রিপুরাদের মধ্যে ৩৬টি গোত্র রয়েছে। তাদের মধ্যে রিয়াং গোত্রটি অন্যতম। কোনো এক শুভ দিনে ১৪ হাজার দেবতার স্বরণ করে হরগ্ৗেরী উদ্দেশ্যে দেশের মঙ্গলার্থে পরিবেশন করা হয়ে থাকে। মৌলভীবাজরের মনিপুরী সম্প্রদায়ের ‘জ্যোতিনন্দন’ দলটি ‘মন্দিরা নৃত্য’ পরিবেশন করেন। নৃত্যটির দলনেতা হিসেবে ছিলেন জ্যোতি সিনহা। মনিপুরী নৃত্য একটি আবশ্যিক বাদ্যযন্ত্র মন্দিরা,মণিপুরি নারীদের নটপালা সংকীর্তন ‘খুবাক- ঈ্শ’ৈ পরিবেশনায় মন্দিরা বাজিয়ে বিভিন্ন তালে লয়ে ছন্দে গান গাওয়া হয়। এই পরিবেশনায় মণিপুরী শিল্পীরা মৃদঙ্গের বিভিন্ন বোলে মন্দিরা বাজিয়ে মণিপুরী নৃত্য পরিবেশন করে। রাঙামাটির পাংখোয়া সম্প্রদায়ের ‘পাংখোয় শিল্পীবৃন্দ’ লাল রৌবেল পাংখোয়া আবেলের নেতৃত্বে ‘শিং নৃত্য’ পরিবেশন করেন। সিয়াল কি দেং বা শিং নৃত্য বলা হয়। মৃতদের স্মরনোৎসব অতি ব্যয় বহুল ভোজ উৎসবের পালন করা। কেবল মৃত্যুর লোকের স্মরণার্থে এই নৃত্যনুষ্ঠান হয়ে থাকে। জীবকালে তার যশ,খ্যাতি ও নানান সুর্কীতি পরিবেশন করাই শিং নৃত্যনুষ্ঠান বিষয়বস্তু হিসেবে শুধু পুরুষরাই অংশগ্রহণ করে থাকে। ধারাবাহিক পরিবেশনায় নেত্রকোনার হাজং সম্প্রদায়ের ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি,বিরিশিরি নেত্রকোনা’ মালা মার্থা আরেং-এর নেতৃত্বে পরিবেশন করেন ‘জীবন ধারা’। সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজং সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনযাপন ও ধর্মীয় উৎসব উদযাপনের ঐতিহ্যবাহী ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির অন্যতম নৃত্য সমূহ যেমন, হালবাওয়া, রোয়া লাগানো ,জাখামারা (মাছধরা), লেওয়াতানা, দিউলী পূজা, মহিষাসুর বধ প্রভৃতি বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয় হাজং নৃত্য গুলো একসূত্রে গেঁথে,বৈচিত্র্যপূর্ণ এই নৃত্যগুলোর সংক্ষিপ্তরূপ পরিবেশনা। মারমা সম্প্রদায়ের ঢাকার ‘কালারস অফ হিল’ অন্তুর দেওয়ানের নেতৃত্বে ‘উৎসব নৃত্য’ পরিবেশন করেন। মারমা‘রা উৎসবপ্রবণ একটি জাতি। তাদের রয়েছে নিজস্ব অক্ষর,ভাষা আর সংস্কৃতি। এই নাচে মারমাদের তিনটি উৎসবের কথা বলা হয়েছে সাংগ্রাই, বিয়ে এবং ভান্তে পোড়ানো। তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের ঢাকার ‘ফুকালাং শিল্পী গোষ্ঠী’ রুমেল তঞ্চঙ্গ্যা’র নেতৃত্বে পরিবেশন করেন ‘মাছ ধরা নৃত্য’। পার্বত্য চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী অন্যতম। এই কর্ণফুলী নদী রাঙামাটি তঞ্চঙ্গ্যাদের জীবন ধারার একটি অংশ। কর্ণফুলী নদীকে কেন্দ্র করে ছিল তাদের এই পরিবেশনা। দিনাজপুরে বসবাসরত সাঁওতাল সম্প্রদায় তাদের ‘ঐতিহ্যবাহী নৃত্য’ পরিবেশন করে। নৃত্য পরিবেশনায় ছিল ‘হিহিড়ি পিপিড়ি শিল্পী গোষ্ঠী’ এবং দলনেতা ছিলেন কৃষ্ণা প্রিয়া মুর্মু। এই নৃত্যের প্রথম ও দ্বিতীয় অংশে সাঁওতালদের ধর্ষীয় উৎসব ‘বাহা’ও ‘সহরায়’ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এবং নৃত্যের তৃতীয় ও চতুর্থ অংশে ১৮৮৫ সালে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ এবং শোষণকারী মহাজন ও জমিদারদের বিরুদ্ধে সংঘটিত মহান সাঁওতাল বিদ্রোহ তুলে ধরা হয়েছে। লুসাই সম্প্রদায়ের ঢাকার ‘তপস্যা’ নৃত্যদল পরিবেশন করে ‘বাঁশ নৃত্য’। নৃত্যটির দলনেতা ছিলেন ফিফা চাকমা। লুসাইদের অন্যতম ঐতিহ্যবাহি একটি নৃত্য হল বাঁশ নৃত্য মৃত ব্যক্তির স্মারণার্থে এই নৃত্যটি পরিবেশিত হয়ে থাকে। সিলেটে বসবাসরত খাসিয়া সম্প্রদায়ের ‘খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’ জুলি খংলা’র নেতৃত্বে পরিবেশন করে দলীয় নৃত্য ‘একতাই বল’। ওঁরাও সম্প্রদায়ের ঢাকার নৃত্যদল ‘কারসা’ পরিবেশন করে ‘মাড়ুয়া নাচ’। এই নৃত্যের দলনেতা ছিলেন বিথী কুজুর। ওঁরাও সম্প্রদায়ের পরিবেশনায় বিয়ের অনুষ্ঠানকে ঘিরে যেখানে সকলে হাতে হাত ধরে পায়ের তাল মিলিয়ে মাড়োয়াকে বিয়ের মন্ডপকে কেন্দ্র করে নাচ করে থাকে। অনুষ্ঠানের সবশেষ পরিবেশনা ছিলো গারো সম্প্রদায়ের নৃত্যদল ‘আনসেংআ আচিক ক্লাব’ এর প্রযোজনা ‘জীবন ও প্রকৃতি’। নৃত্যটির দলনেতা ছিলেন মিশ্রা চিসিম। এই গানে গারো সমাজে নারী-পুরুষ একসাথে কাজ করে। কাজে যাওয়ার সময় নারীরা মাথায় ঝুরি আর সন্তান সাথে নিয়ে যায়। জুম পাহাড়ে কাজ করার সময় পানি পিপাসা পেলে কাছের ঝর্ণার থেকে পানি পান করে। পাখিদের মিষ্টি মধুর ডাক ভেসে আসে। কাজ করতে করতে দিন শেষে সন্ধ্যা নেমে আসে। এভাবে পূর্বপুরুষ থেকে শুরু করে নিজেদের জীবন জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছে। এই নৃত্য পরিবেশনের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত ঐতিহ্যবাহী উৎসব।