শিরোনাম
ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর, ২০২৩ (বাসস) : ‘আমি টাকা জমা করছি আল্লাহর কাছ থেকে আমার বাবাকে কিনে আনবো। আমি বড় হয়ে পুলিশ অফিসার হবো।’
গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির সমাবেশের দিন হত্যাকান্ডের শিকার পুলিশ সদস্য আমিরুল ইসলাম পারভেজের ছোট্ট মেয়ে তানহা আজ রাজধানীতে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই কথাগুলো বলেন।
আজ রোববার রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা অডিটোরিয়ামে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে ‘মায়ের কান্না’ ও ‘অগ্নি-সন্ত্রাসের আর্তনাদ’ নামের দুটি সামাজিক সংগঠন যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
এই অনুষ্ঠানে আমিরুল ইসলামের স্ত্রী রুমা আক্তার বলেন, ‘আমিরুলকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, আমরা তার মুখটাও দেখতে পারিনি। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি জানাই যে- আমিরুলকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে, হত্যাকারীদের যেন তার চেয়েও কঠিন শাস্তি দেওয়া হয়।’
বলেন, ২৮ অক্টোবর বিএনপির-জামায়াতের সহিংসতার শিকার আমার স্বামী। তার কী দোষ ছিল? কেন তাকে হত্যা করা হলো? সে তো কোন রাজনীতি করত না। তাকে কেন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে হত্যা করা হলো?
রুমা আক্তার বলেন, ‘ছয় বছরের তানহা বারবার প্রশ্ন করে, বাবা কবে আসবে? কোনো পুলিশ সদস্য টাকা দিলে সেই টাকা সে জমিয়ে রাখে এবং টাকা জমিয়ে তার বাবাকে সে কিনে আনবে বলে। বড় হয়ে আমার মেয়ে পুলিশ হবে এবং বাবার হত্যার বিচার করবে।’
তিনি বলেন, ‘আমার দুই সন্তান তাদের বাবার লাশ ধরতে পারেনি। তাদের এখন একটাই প্রতিজ্ঞা পুলিশ হয়ে বাবা হত্যার বিচার করা। পুলিশ দেখলেই তারা বাবাকে খোঁজে।’
সম্প্রতি বিএনপির অবরোধ চলাকালে আছিম পরিবহনের একটি বাসে আগুন দিলে বাসটির মধ্যে ঘুমিয়ে থাকা হেলপার আবু নাঈম পুড়ে মারা যান। অনুষ্ঠানে আবু নাঈমের মা তার বক্তব্যে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলাম-বিএনপি মানুষ পুড়িয়ে মারছে। আমার ছেলেকে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে এর কঠিন বিচার চাই। তারা যাতে বুঝতে পারে সন্তান হারানো মায়ের কষ্ট কি- সেজন্য তাদের কঠিন বিচার চাই।’
এ ছাড়া অগ্নি সন্ত্রাসীদের দ্রুত বিচার দাবি জানিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে বিএনপি-জামায়াতের আন্দোলনের নামে সন্ত্রাস ও নাশকতার শিকার ক্ষতিগ্রস্তরা। একই সঙ্গে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মরণত্তোর বিচার দাবি করেন তারা।
সভায় জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন আমলে সশন্ত্র বাহিনীতে হত্যাকান্ড, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপিÑজামায়াত ক্ষমতায় আসার পর সংঘটিত হত্যা-নির্যাতন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে বিএনপি-জামায়াতের হরতাল-অবরোধকালে সংঘটিত অগ্নি সন্ত্রাস ও ভাঙচুরের ঘটনায় আহত, ক্ষতিগ্রস্ত ও নিহতদের পরিবারের সদস্য এবং গত ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত বিএনপির সমাবেশ, অবরোধের নিহতও ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা বক্তব্য রাখেন।
অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য কামরুল ইসলাম, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া ও শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী উপস্থিত ছিলেন।
বক্তারা বলেন, জিয়াউর রহমানের মরণত্তোর এবং অগ্নি সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত বিচার করতে হবে- যাতে এই ধরণের ঘটনা অভিষ্যতে আর কেউ ঘটাতে সাহস না পায়।
অনুষ্ঠানে আহতরা ঘটনার শিকার হওয়ার সময় ও ঘটনা-পরবর্তী জীবনের কথা তুলে ধরেন। নিহতদের পরিবারের সদস্যরা তুলে ধরেন তাদের স্বজন হারানোর বেদনার কথা।
শুরুতে জিয়াউর রহমানের সামরিক ট্রাইব্যুনালে সশন্ত্রবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সদস্যদের বিচার, ২০০১ সালের বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা এবং ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালের অগ্নি সন্ত্রাসের উপর তথ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়।
অনুষ্ঠানে মনোহরদী উপজেলার ব্যবসায়ী সায়েম বলেন, ২০১৩ সালে রাস্তায় গাছ ফেলে অবরোধ করেছিল বিএনপি জামায়াতের লোকজন। ওই সময় একজন মা অসুস্থ হয়ে হাসপাতাল যেতে চাইলে তাকে যেতে দেওয়া হয়নি। আমি তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। এতেই আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আগুন দেয় তারা। এরপর আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি।
ঢাকা জজ কোর্টের এডভোকেট খোদেজা নাসরিন। ২০১৩ সালে রাজধানীর শাহবাগে বিহঙ্গ বাসে পেট্রোল বোমা মারা হয়। সেই বাস থেকে কোনোভাবে বের হলেও সারাজীবনের জন্য পঙ্গুত্ব বরণ করেন তিনি।
তিনি বলেন, সে দিনের আগুনে আমার দুটি হাত ক্ষত-বিক্ষত হয়ে যায়। মানবাধিকার দিবসের আমার একটাই দাবি, এসব অগ্নি-সন্ত্রাস যারা করছে, তাদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনা হোক।
১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর বিদ্রোহ দমনের নামে বিমানবাহিনীর সহ¯্রাধিক সদস্য গুমের ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয় ‘মায়ের কান্না’ সংগঠন। ১৯৭৭ সালে মৃত্যুদ্বন্ড বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট সাইদুর রহমান মিঞার ছেলে মো. কামরুজ্জামান মিঞা লেলিন এ সংগঠনের সমন্বয়ক।
তিনি বলেন, ১৯৭৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকায় জাপানি বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনায় তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান পরিকল্পিতভাবে একটি অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট তৈরি করেন। পরবর্তীতে তথাকথিত বিদ্রোহ দমনের নামে জিয়াউর রহমান একদিনের সামরিক আদালতে বিচার করে সেই রাতেই ফাঁসি সম্পন্ন করেন নিরপরাধ সামরিক সদস্যদের। রাতের আঁধারে কারফিউ দিয়ে ঢাকা, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রংপুর, যশোর ও বগুড়া কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসি কার্যকর করা হতো। আমরা জিয়াউর রহমানের মরণোত্তর বিচার দাবি করছি।
অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এডভোকেট তারানা হালিম ও শহীদ বুদ্ধিজীবী আব্দুল আলিম চৌধুরীর মেয়ে ডা. নুজহাত চৌধুরী।