ময়মনসিংহের দরিরামপুরে অবহেলায় জাতীয় কবির স্মৃতিকেন্দ্র

বাসস
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১৯:১৫
অবহেলায় জাতীয় কবির স্মৃতিকেন্দ্র। ছবি : বাসস

 মো. আব্দুল কাইয়ুম

ময়মনসিংহ, ২৭ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু একটি সাহিত্যিক নাম নয়, তিনি বাঙ্গালি জাতির মুক্তি, দ্রোহ, প্রেম ও সাম্যের প্রতীক। তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় কেটেছে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুরে। এখানকার বিদ্যালয়, গ্রাম ও মানুষের সঙ্গে তাঁর স্মৃতি জড়িয়ে আছে অঙ্গাঙ্গিভাবে। সেই স্মৃতি ধরে রাখতে গড়ে তোলা হয়েছে দুটি নজরুল স্মৃতি-কেন্দ্র। কিন্তু এসব কেন্দ্র আজ অবহেলায় জর্জরিত হয়ে পড়েছে। দর্শনার্থীরা আসেন, কিন্তু ফিরে যান হতাশ হয়ে।

ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলেই কিশোর নজরুলের পড়াশোনা। পরবর্তীতে এই বিদ্যালয়টির নামকরণ হয় ত্রিশাল সরকারি নজরুল একাডেমি। ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই প্রতিষ্ঠানটি কবির স্মৃতি বহন করছে আজও। ১৯৬৪ সালে বিদ্যালয়টির নামকরণ হয় নজরুলের নামে এবং ২০১৮ সালে এটি সরকারিকরণ হয়। বিদ্যালয়ের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে, কবির স্মৃতি বিজড়িত দুটি কেন্দ্র। একটি ত্রিশালের দরিরামপুর নামাপাড়া ও আরেকটি কাজীর শিমলায়।

এই স্মৃতিকেন্দ্রের ভেতরে রাখা আছে কবির ব্যবহৃত কিছু অমূল্য নিদর্শন। এখানে রয়েছে পুরনো গ্রামোফোন, এইচএমভি কোম্পানির রেকর্ড, বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও উর্দু ভাষায় লেখা তাঁর কিছু পান্ডুলিপি এবং আলোকচিত্র। এগুলো কবির কৈশোরের দিনগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে নতুন কিছুই যোগ হয়নি। দর্শনার্থীরা অভিযোগ করেন, সংগ্রহগুলো স্থবির হয়ে আছে, কোনো ব্যাখ্যামূলক প্যানেল বা গাইড নেই। ফলে যারা কবির জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানতে চান, তারা পর্যাপ্ত তথ্য পান না।

প্রতিষ্ঠাকাল নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। স্থানীয়রা দাবি করেন, ২০০৩ সালের দিকে দুটি কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয়। আবার সরকারি নথি ও অনলাইন তথ্য বলছে, ২০০৮ সালে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে কেন্দ্রগুলো প্রতিষ্ঠিত হয়। এ বিভ্রান্তি এখনো দূর হয়নি। ফলে বাজেট বরাদ্দ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নিয়েও স্পষ্টতা নেই।

অবকাঠামোগত দুর্বলতাও প্রকট। কেন্দ্রগুলোতে যথাযথ আলোকসজ্জা নেই, সংরক্ষিত সামগ্রীর জন্য তাপ ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নেই। নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি বা আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নেই। দর্শনার্থীদের জন্য নেই বিশ্রাম কক্ষ বা ভিজিটর সেন্টার। ফলে পর্যটন সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেটি কাজে লাগানো যাচ্ছে না।

তবে সব অন্ধকারের মাঝেও আশার আলো রয়েছে। ত্রিশালের এ স্মৃতি কেন্দ্রগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এখানে কিশোর নজরুলের জীবন ও সৃজনশীলতার সূচনা ঘটেছিল। কাজীর শিমলায় সাব-ইন্সপেক্টর কাজী রফিজুল্লাহর বাড়িতে তাঁর লেখালেখির নিদর্শন পাওয়া যায়। 

স্থানীয় কলেজ শিক্ষক আতাউর রহমান মনে করেন, দরিরামপুর হাই স্কুল এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়কে একীভূত করে গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম চালানো গেলে এ অঞ্চল হয়ে উঠতে পারে নজরুল চর্চার কেন্দ্র।

স্থানীয়দের প্রত্যাশা, এখানে নিয়মিত সাংস্কৃতিক আয়োজন হোক। নজরুল সঙ্গীত কর্মশালা, কবিতা আবৃত্তি, নাটক ও গবেষণা আলোচনা হলে তরুণ প্রজন্ম নতুনভাবে কবিকে আবিস্কার করতে পারবে। বার্ষিক উৎসবের মাধ্যমে নজরুলকে ঘিরে সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটানো সম্ভব। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গাইড হিসেবে নিয়োগ দিলে তারা শুধু ইতিহাস জানবে না, বরং গর্বের সঙ্গে অন্যদেরও জানাতে পারবে।

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী রাশেদুজ্জামান রনি বলেন, নজরুল স্মৃতিকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজন পরিকল্পিত উন্নয়ন। সংরক্ষিত পান্ডুলিপি ও আলোকচিত্রের ডিজিটাল আর্কাইভ তৈরি করতে হবে। জাতীয় জাদুঘর ও নজরুল ইনস্টিটিউটের সঙ্গে সমন্বয় করে যৌথ প্রদর্শনী আয়োজন করা যেতে পারে। পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে “নজরুল ট্রেইল, ত্রিশাল” নামে একটি ওয়েবসাইট ও ভ্রমন গাইড তৈরি করা জরুরি। 

সরকারি নথি অনুযায়ী কেন্দ্রগুলো সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন। কিন্তু মাঠ পর্যায়ে সুনির্দিষ্ট জবাবদিহি নেই। কোথাও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের নাম শোনা যায়, আবার কোথাও মন্ত্রণালয়ের উল্লেখ মেলে। এ কারণে একটি স্পষ্ট স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর প্রণয়ন জরুরি, যাতে সংগ্রহ সংরক্ষণ, বাজেট বরাদ্দ ও জনবল নিয়োগে স্বচ্ছতা থাকে।

এব্যাপারে ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল বাকিউল বারী বাসসকে বলেন, এটা মূল নজরুল ইনস্টিটিউটের অধীনে। সেখান থেকেই দুটি স্মৃতিকেন্দ্রের দেখা শুনা করা হয়। আমরাও চেষ্টা করি আপডেট করে রাখার জন্য। তবে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সংষ্কারের প্রয়োজন। বিল্ডিংগুলো জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবছরই ত্রিশালে তিনদিনব্যাপী নজরুল জন্মজয়ন্তী উৎসবের আয়োজন করা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক দর্শনার্থী ও গবেষকরা আসেন। এবং দুটি স্মৃতিকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এই দুটি প্রতিষ্ঠানের আরো সংস্কার করার জন্য উপেজেলা প্রশাসনের তরফ থেকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়কে জানানো হবে।

নজরুল গবেষকদের দাবি, ত্রিশালের দরিরামপুর ও কাজীর শিমলার এই দুটি কেন্দ্র শুধুমাত্র জাদুঘর নয়, বরং জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। এগুলোকে আধুনিকায়ন ও গবেষণাবান্ধব করে গড়ে তোলা গেলে নজরুলচর্চার অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে ত্রিশাল নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে। জাতীয় কবির উত্তরাধিকার বাঁচিয়ে রাখা শুধু ত্রিশালের নয়, বরং গোটা জাতির দায়িত্ব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
অধ্যাপক ড. এম. শমশের আলীর স্মরণসভা অনুষ্ঠিত
চৌদ্দগ্রাম উপজেলা ও পৌরসভা বিএনপির দ্বি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত
প্রতি কেজি আলুর সর্বনিম্ন মূল্য ২২ টাকা নির্ধারণ
ডিপ্লোমা কৃষিবিদদের পদোন্নতি জটিলতা : সমাধান চায় ডিকেআইবি
ডেঙ্গুতে আজ ৪৩০ জন আক্রান্ত
সমুদ্র বন্দরসমূহে ৩ নম্বর সতর্ক সংকেত
ফ্যাসিস্ট হাসিনা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করেছেন: রিজভী
আইভরি কোস্টে প্রেসিডেন্ট পদে লড়তে চান ৬০ জন
আফগানিস্তানে বাস দুর্ঘটনায় নিহত ২৫
পল্লী এলাকার অবকাঠামো উন্নয়নে বর্তমান সরকার বদ্ধপরিকর: পিরোজপুর জেলা প্রশাসক
১০