২০০ বছর ধরে বিখ্যাত টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম: স্বীকৃতি পেয়েছে জিআই পণ্য হিসেবে

বাসস
প্রকাশ: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৮:৩৮
টাঙ্গাইলের বিখ্যাত পোড়াবাড়ির চমচম । ছবি: বাসস

//মহিউদ্দিন সুমন//

টাঙ্গাইল, ১১ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : জেলার পোড়াবাড়ি "চমচম" শব্দটি উচ্চারিত হলেই মানসপটে ভেসে উঠে মাওয়ার আস্তরণে রসালো স্বাদযুক্ত মিষ্টির প্রতিচ্ছবি। যুগ যুগ ধরে রসনা বিলাসী বাঙালির তৃপ্তিদায়ক মিষ্টান্ন এই চমচম। চমচম বলতে বাঙালি একবাক্যে বুঝে নেয় টাঙ্গাইল তথা পোড়াবাড়ির প্রসিদ্ধ চমচমের কথা।

তাই সৃষ্টি হয়েছে প্রবাদ- "চমচম, টমটম, শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি" টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচমের খ্যাতি রয়েছে দেশে-বিদেশে। বিয়ের অনুষ্ঠান, জন্মদিনে, পূজাপার্বণসহ সকল উৎসবে রসনাবিলাসীদের তৃপ্তি যোগাতে এই চমচমের উপস্থিতি সর্বত্র। শুধু নামেই নয়, আকৃতি আর স্বাদ-গন্ধেও সেরা পোড়াবাড়ির চমচমকে বলা হয় ‘মিষ্টির রাজা’। 

টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়িতে উৎপাদিত সেই বিখ্যাত চমচম বর্তমানে তার জন্মস্থানেই নিরুদ্দেশ হওয়ার পথে। টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারের মিষ্টি পট্টিতে টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম পাওয়া গেলেও খোদ পোড়াবাড়িতে অস্তিত্ব হারিয়েছে অনেক আগেই। কালের বিবর্তনে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এখন মাত্র ৮-১০টি বাড়িতে চমচম তৈরি করা হয়। ইতোমধ্যে চমচম তৈরির বিখ্যাত কয়েকটি পরিবার ভিন্ন পেশায় যুক্ত হয়েছেন।

টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসকের আবেদনের প্রেক্ষিতে সরকারের ভৌগলিক নিদের্শক ইউনিট ভৌগলিক নিদের্শক পণ্য (নিবন্ধন ও সুরক্ষা) আইন ২০১৩ অনুয়ায়ী ২০২৪ সালের ২৫ এপ্রিল টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির চমচম জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পায়।

সরেজমিনে টাঙ্গাইল শহর থেকে মাত্র ৬ কিলোমিটার পশ্চিমে পোড়াবাড়িতে পৌঁছি ইজিবাইকে চেপে। মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর জন্মস্থান সন্তোষ হয়ে দুইপাশের অপরূপ দৃশ্যাবলী দেখতে দেখতে পৌঁছাই পোড়াবাড়িতে। 

ধলেশ্বরীর শাখা নদী এ্যালনজানীর বামতীর ঘেঁষে সদর উপজেলার পোড়াবাড়ি ইউনিয়ন তথা পোড়াবাড়ি গ্রাম। পোড়াবাড়ি টাঙ্গাইল সদর উপজেলার একটি ছোট্ট গ্রাম হলেও ধলেশ্বরী নদীর তীরে গ্রামটি অবস্থিত হওয়ায় এর চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য যে কাউকেই টানবে। তবে পোড়াবাড়ি বাজারে মিষ্টির দোকান টিকে রয়েছে মাত্র ৪টি।

অন্যদিকে বেশি দুধের আশায় বিভিন্ন ধরনের বিদেশি গরু এখন পালন করেন স্থানীয় খামারিরা। ফলে দুধের সেই স্বাদও নেই। তারপরও প্রতিদিন পোড়াবাড়িতে দুধের বাজার বসে। ইতিপূর্বে প্রতিদিন ২০০ থেকে ৩০০ মণ দুধ বিক্রি হলেও এখন তা কমে গিয়ে ১০০ মণে দাঁড়িয়েছে। দাম ৭০ টাকা থেকে ৮০ টাকা কেজি। বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ঘোযরা এ বাজার থেকে গরুর খাঁটি দুধ কিনে নিয়ে যায় মিষ্টি তৈরি করার জন্য কারখানাগুলোতে।

এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, ধলেশ্বরী নদীটি দাইন্যা ইউনিয়নের চারাবাড়ী ঘাট থেকে বাঁক নিয়ে দক্ষিণে চলে যাওয়ার আগে পোড়াবাড়ির দিকে এ্যালনজানী শাখা নদী তৈরি হয়েছে। সে সময় ঢাকা-কলকাতা গামী লঞ্চ-স্টিমারের ভেঁপুর উচ্চশব্দে চারাবাড়ি-পোড়াবাড়ির কূলবধূ থেকে শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবক, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সহ নারী-পুরুষ ‘জাহাজ’ দেখতে ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে আসতো। 

ধলেশ্বরী নদীর ঘাট চারাবাড়ীতে থাকলেও পাশের পোড়াবাড়িই ছিল মূলত প্রসিদ্ধ চমচমের আতুর ঘর। আর পোড়াবাড়ির এ চমচমই ভারতবর্ষসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের কাছে টাঙ্গাইলকে ব্যাপক পরিচিতি এনে দেয়।

চমচম তৈরির ইতিহাস বলছে- দশরথ গৌড় নামে এক ব্যক্তি ব্রিটিশ আমলে আসাম থেকে টাঙ্গাইলের ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী পোড়াবাড়িতে আসেন। তিনি ধলেশ্বরীর পানি ও গরুর খাঁটি দুধ দিয়ে প্রথমে চমচম তৈরি শুরু করেন। এর আগে ১৬০৮ সালে ধলেশ্বরীর পশ্চিম তীরে গড়ে উঠেছিল জমজমাট ব্যবসাকেন্দ্র পোড়াবাড়ি বাজার। 

আবার কেউ কেউ মনে করেন, উনবিংশ শতকের গোড়ার দিকে দশরথ গৌড়ের পর তার আত্মীয় রাজা রামগৌড়, নারায়ণ গৌড়, কোশাই দেব, দুই সহোদর মদন হালুই ও কোকন হালুই, মোহন লাল, শিব শঙ্কর গৌড়, প্রকাশ চন্দ্র দে সরকার প্রমুখ পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করতেন। এদের মধ্যে পাকিস্তান আমলে নারায়ণ গৌড় পোড়াবাড়ির চমচম তৈরি করে উপমহাদেশে প্রসিদ্ধ হন। বাঙালিদের মধ্যে চমচম তৈরি করে প্রসিদ্ধ হওয়ায় মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী তাকে ‘বাঙালি হালুই কর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। 

ত্রিশ দশকের শেষের দিকে আসামের রামেন্দ্র ঠাকুর, তীর্থবাসী ঠাকুর টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজারে মিষ্টি তৈরি ও ব্যবসা শুরু করেন। এরপর থেকেই টাঙ্গাইল শহরের পাঁচআনী বাজার ‘মিষ্টি পট্টী’ নামে পরিচিতি লাভ করে। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পোড়াবাড়ি গ্রামের গোড়াপত্তনের পেছনে মুঘল সুবেদার ইসলাম খাঁ নিয়োজিত শাসক পীর শাহজামানের কৃতিত্ব ছিল। ১৬০৮ থেকে ১৬১৩ সালের মধ্যে ইসলাম খাঁ কাগমারী পরগনার শাসনভার শাহ জামানের ওপর র্অর্পন করেছিলেন। সে সময় চারাবাড়ীর গ্রামের দক্ষিণ অংশে ভয়াবহ এক অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বাজার ও বসতবাড়ি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর থেকে ওই এলাকাকে পোড়াবাড়ি বলা হত। 

১৯৬০ সালে তৎকালীন টাঙ্গাইল মহকুমার যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হলে ঢাকা-টাঙ্গাইল, টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহসহ দেশের অন্যসব জেলার সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির ফলে চমচমের সুখ্যাতি দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে।

আরও জানা যায়, এ দেশের বহু বিখ্যাত ব্যক্তির প্রিয় খাদ্যের তালিকায় ছিল পোড়াবাড়ির চমচম। এদের মধ্যে রয়েছেন- শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, যাদু সম্রাট পিসি সরকার, নবাব আলী চৌধুরী, জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, প্রিন্সিপাল ইবরাহীম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরী প্রমুখ।

পোড়াবাড়ির মিষ্টি ব্যবসায়ীদের মধ্যে বর্তমানে খোকা ঘোষ ও গোপাল চন্দ্র দাসের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে বর্তমানে টাঙ্গাইলের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি শিল্পের প্রতিনিধিত্ব করছে জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার, গোপাল মিষ্টান্ন ভান্ডার ও গৌর ঘোষ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার। এছাড়াও পাঁচআনি বাজারে অর্ধশত মিষ্টির দোকান রয়েছে। 

আর এ চমচম এশিয়ার মধ্যে ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, চায়না ও ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে আমেরিকা, ইংল্যান্ডসহ কানাডা ইত্যাদি দেশে। আর মধ্যপাচে, দুবাই, সৌদি আরব, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে অহরহ। 

পোড়াবাড়ির চমচম তৈরির বয়োবৃদ্ধ কারিগররা জানান, তাদের পূর্ব-পুরুষের আমল থেকে এ পেশায় জীবিকা নির্বাহ করছেন। ছোটবেলায় তারা এক হাড়ি দুধের দাম দু’পয়সা থেকে ৪’পয়সায় বেচাকেনা করত। চিনি পাওয়া যেত ৩ আনা থেকে ৫ আনা সের দরে। আর চমচম বিক্রি হতো ৬ আনা থেকে ৮ আনা সের দরে। বর্তমানে পোড়াবাড়িতে ৪টি ও চারাবাড়ীতে ৫টি মিষ্টির দোকান রয়েছে। 

মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের কিছু আগে ষাটের দশকে পোড়াবাড়ির প্রসিদ্ধ চমচমের দাম ছিল সের প্রতি ২ থেকে ৩ টাকা। 

টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িতরা এ শিল্পকে ধরে রাখতে প্রাণান্তকর চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু অতি মুনাফালোভী কতিপয় মিষ্টি ব্যবসায়ীর কারণে টাঙ্গাইলের প্রসিদ্ধ চমচম ঐতিহ্য হারিয়ে অস্তিত্ব হারানোর দ্বারপ্রান্তে পৌঁচেছে। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ১৫ কেজি দুধ জ্বাল দিয়ে শুকিয়ে পাওয়া যায় আধা কেজি মাওয়া। 

পোড়াবাড়ি বাজারের শংকর মিষ্টান্ন ভান্ডার এর স্বত্বাধিকার প্রদীপ চন্দ্র গৌড় জানান, ১০০ বছর ধরে তাদের পরিবার চমচম শিল্পের সাথে জড়িত। বাঙালি দাদুর কাছে তার চমচম তৈরিতে হাতেখড়ি। এই পোড়াবাড়িতে আমাদের দাদা চন্দ্র গৌড় ও গোসাই চন্দ্র গৌড় বিখ্যাত টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ি চমচম তৈরি করতেন। এখনো আমরা ভালো চমচম তৈরির চেষ্টাই করছি। 

পোড়াবাড়ি চমচম এর স্বত্বাধিকারী শ্রীমন্টু চন্দ্র গৌড় জানান, পোড়াবাড়ির চমচমের মূল রহস্য ধলেশ্বরী নদীর মিঠা পানি, গরুর খাঁটি ঘণ দুধ, লালচিনি ও দুর্লভ তেঁতুলের লাকড়ী এবং তাপ নিয়ন্ত্রণ। স্বাধীনতার পরেও তিনি প্রতিদিন ২-৩ মণ চমচম বিক্রি করতেন। বর্তমানে প্রতিদিন ২০-২২ কেজি চমচম বিক্রি করাও দূরূহ। পরিশ্রমের তুলনায় পারিশ্রমিক না পাওয়ায় চমচম তৈরির আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। 

অরজিনাল টাঙ্গাইল পোড়াবাড়ির চমচম তৈরিতে দাম পড়বে ৪০০ টাকা কেজি। আমরা একটু নিম্নমানের চমচমও তৈরি করি যা ২৫০ টাকা কেজি ধরে বিক্রি করি। 

ঢাকা থেকে কিনতে আসা মিষ্টির ক্রেতা মানিক মিয়া বলেন, দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে টাঙ্গাইলের মিষ্টি অনেক সুস্বাদু, বছরে কয়েকবার এসে মিষ্টি কিনে নিয়ে যাই ঢাকায়। 

জেলা হোটেল রেস্তোরা ও মিষ্টির দোকান মালিক সমিতির সভাপতি ও জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার এর স্বত্বাধিকারী স্বপন ঘোষ জানান, আমার প্রতিষ্ঠান জয় কালী মিষ্টান্ন ভান্ডার দীর্ঘ ৮৫ বছর ধরে মিষ্টির স্বাদ ও গুণগত মান বজায় রেখে সততা ও নিষ্ঠার সাথে ব্যবসা পরিচালনা করে আসছি। দেশের বাইরেও চাহিদা বাড়ছে ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের চমচমের। 

জেলা বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কমিটির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা হামিদুল হক মোহন বলেন, সে সময়ে টাঙ্গাইলের চারাবাড়ীতে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ঘাট স্থাপনের পর এ এলাকা ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। দেশি-বিদেশি বণিক ও বেনিয়ারা টাঙ্গাইল থেকে পাট কেনার জন্য এসে পোড়াবাড়ির চমচম নিয়ে বাড়ি ফিরতো। আগের সেই ঐতিহ্যবাহী চমচমের স্বাদ পাওয়া যায় না। তবে এদের মধ্যে স্বপন ঘোষ ও গোপাল চন্দ্র ঘোষ এখন পর্যন্ত গুণগত মান বজায় রেখে তারা মিষ্টি তৈরি করে আসছে। আশা করি ভবিষ্যতেও তারা ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ি চমচম এর স্বাদ ও মানের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখবে। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা অন্তর্বর্তী সরকারের অঙ্গীকার : নৌ-পরিবহন উপদেষ্টা
ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে দুইদিনে ডিএমপির ২,৫৮৬ মামলা 
সরকার সকল ধর্ম ও সম্প্রদায়ের প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল : পার্বত্য উপদেষ্টা 
গাজা সফর করলেন মার্কিন শীর্ষ সামরিক কমান্ডার
মা ইলিশ সংরক্ষণে নৌবাহিনীর অভিযান : ১৯ কোটি টাকার মালামাল জব্দ
সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১,৬৮৩
জেলেনস্কি এবং ট্রাম্পের মধ্যে আলোচনা : ইউক্রেনের রাষ্ট্রপতি
ইসরাইলি বাহিনী আমাকে মানসিক নির্যাতন করেছে : শহিদুল আলম
মানসিক স্বাস্থ্য সচেতনতা বিষয়ে জাকসু’র সেমিনার অনুষ্ঠিত
বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নে কুমিল্লায় কর্মীসভা ও গণসংযোগ
১০