
আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ১ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস) : জেলার বিস্তীর্ণ নদীপথে অসংখ্য ডুবোচর জেগে ওঠায় নাব্যতা সংকটে নৌচলাচলে চরম দূর্ভোগ। বিশেষ করে উপকূলীয় জেলা ভোলার ইলিশা-লক্ষ্মীপুরের মজুচৌধুরীর হাট, দৌলতখান-চর আলেকঝান্ডার, ভোলা-বরিশাল, ভোলা-মেহেন্দীগঞ্জ ও ভোলা-পটুয়াখালী নৌপথের মেঘনা, তেতুলিয়া, কালাবাদর, বুড়া গৌড়ঙ্গা, বেতুয়া এবং ইলিশা নদীর বিশাল জলপথে অসংখ্য ডুবোচরে নাব্যতা সংকট-প্রকট আকার ধারণ করেছে। ফলে ফেরি-লঞ্চ পারাপারে সময়, অর্থ ও অন্ত:হীন ভোগান্তি বেড়েই চলেছে।
সরেজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মেঘনা নদীর মধ্যভাগে ভোলার ইলিশা ফেরিঘাটের সামনে পূর্বদিক বরাবর বিশাল ডুবোচর জেগেছে। উত্তর-দক্ষিণ বরাবরও বহু এলাকাজুড়ে এ চর বিস্তৃত আকারে জেগে উঠেছে। নদীতে ভাটার সময় এসমস্ত চর জেগে উঠে আবার জোয়ারে অনেকাংশ ডুবে যায়। এ ডুবোচরের কারণে নৌযানগুলোর কোনোটি উত্তরে বঙ্গের চর হয়ে, কোনোটি দক্ষিণে তুলাতুলি এলাকা হয়ে লক্ষ্মীপুর যেতে হচ্ছে। ভোলা-লক্ষ্মীপুর রুটের ফেরিগুলো যাচ্ছে দক্ষিণের তুলাতুলি-কাচিয়া মাঝের চর এলাকা হয়ে।
এ রুটের লঞ্চ যাত্রী, গাড়ি চালক, লঞ্চের মাস্টার-সুকানি ও ফেরির মাস্টারদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ডুবোচরের কারণে লঞ্চ ও ফেরিগুলোকে ছয়-সাত কিলোমিটার ঘুরে দক্ষিণের তুলাতুলি-কাচিয়া এলাকা হয়ে লক্ষ্মীপুরে যেতে হচ্ছে। অনেক লঞ্চ ভোলা নদী এলাকার বঙ্গের চর হয়ে ঘুরে ঘুরে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, ডুবোচর কাটিয়ে পূর্বে লক্ষ্মীপুরের দিকে এগোলে মাঝ নদীর কয়েকটি স্থানে কমপক্ষে ৭/৮টি ডুবোচর পড়েছে। তখন নৌযানগুলোকে খুব সতর্ক হয়ে চলাচল করতে হয়। নচেৎ লঞ্চ-ফেরি সময়মতো লক্ষ্মীপুর মজুচৌধুরীর হাট, রহমতখালী খালের মুখে পৌঁছাতে না পারলে ডুবোচরে আটকে পড়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হয়। তখন জোয়ারের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে হয়। মাঝে মধ্যে জোয়ার আসলেও ডুবোচর থেকে লঞ্চ- ফেরিগুলো সরানো সম্ভব হয়না।
এসব নৌপথ ধরে ফেরিতে যাতায়াত করতে যেখানে দুই-আড়াই ঘন্টা লাগে, ডুবোচরের কারণে সেখানে সময় লাগছে অন্তত সাড়ে তিন থেকে ৪ ঘন্টা। আর লঞ্চযোগে চলতে যেখানে সময় লাগে সোয়া এক ঘন্টা, এখন লাগছে পৌনে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা।
ফেরি ও লঞ্চ চালকরা জানান, লক্ষ্মীপুরে রহমতখালী খালে বছরজুঁড়ে খননকাজ চলতে থাকে। তবুও নদী-খালে পানি থাকে না।
ভোলা থেকে ফেরিযোগে চট্টগ্রামগামী ট্রাকচালক বশির, আলাউদ্দিন ও কামরুল মিয়া বলেন, ডুবোচরের কারণে ফেরি পারাপারে অধিক সময় লাগে। ভোলা-বরিশাল ও ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌরুটের দুই পাড়ে সব সময় গাড়ির দীর্ঘ জট লেগেই থাকে। আর এসময় এক দিনের জায়গায় কখনো কখনো ঘাটে তিন-চার দিন থাকতে হচ্ছে। অথচ দুই পাড়ের এসব ঘাটে কয়েক ঘন্টার বেশি সময় ধরে থাকার পরিবেশ নেই। এখানে না আছে গাড়ি রাখার স্থান, না আছে টয়লেট। আর ভালো কোনো খাবারের হোটেল নেই। ফলে নদীর ঘাটেই মানবেতর অবস্থায় থাকতে হয় সবাইকে।
ভোলার ইলিশা লঞ্চ ও ফেরিঘাটের ইজারাদার জামাল উদ্দিনের সাথে হলে তিনি বলেন, ডুবোচরের কারণে একটি ফেরি দিনে দুই থেকে তিনটি ট্রিপের বেশি দিতে পারছে না। ফলে গাড়ির চালক ও যাত্রীদের ভোগান্তি বাড়ছে।
এ নৌপথে চলা কুসুমকলি ফেরির মাস্টার অলিউর রহমান বলেন, ডুবোচরের কারণে ফেরিগুলোকে বাড়তি ছয় কিলোমিটার ঘুরতে হয়। নৌযানগুলোর পানি মেপে মেপে চালাতে হচ্ছে। এতে দুই থেকে পাঁচ ঘন্টা সময় বেশি লাগছে। এতে জ্বালানি তেলের খরচ বেশি হচ্ছে। এছাড়াও চরে আটকে প্রায়ই এসব ফেরি ও লঞ্চ বিকল হচ্ছে।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) এর ইলিশা ঘাটের ব্যবস্থাপক মো. কাউসার হোসেন বলেন, এ নৌপথে এখন কুসুমকলি, কলমীলতা ও কিষাণী নামক তিনটি ফেরি চলছে। দিন-রাত ফেরি চলার পরও দুই ঘাটে দুই/তিন শতাধিক গাড়ি আটকে থাকে। এ নৌপথের প্রধান সমস্যা নাব্যতা সংকট। তিনি বলেন, ডুবোচরের কারণে ফেরি পারাপারে সময় বেশি লাগছে। তারপরও দিনে ছোট-বড় চার শতাধিক গাড়ি পার হচ্ছে। ডুবোচরের কারণে একদিকে সময় ও অর্থের অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে চরে আটকে ফেরির পরিচালনা ব্যবস্থা বারবার বিকল হচ্ছে। যাত্রী ও চালকরা ভোগান্তির চরম শিকার হচ্ছেন।
এ বিষয়ে কথা হয়, বাংলদাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিটিএ)'র খনন বিভাগের বরিশাল বিভাগীয় নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মামুন অর রশিদের সাথে। তিনি বাসস'কে জানান, ভোলা-লক্ষ্মীপুর নৌপথের নাব্যতা সংকট ও ডুবোচরের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে রয়েছে। ইতিমধ্যে ভোলার ভেদুরিয়া ও পাঙ্গাসিয়া নদীতে নাব্যতা বাড়াতে ড্রেজিংকাজ চলমান আছে। তিনি জানান, চলতি মাসের শেষ নাগাদ লালমোহনের গাছির খাল ও চরফ্যাশনের কচ্ছপিয়া এলাকার বেতুয়া-কুকরী মুকুরী নৌরুটের ডুবোচরের ড্রেজিংকাজ শুরু হবে।
বিআইডব্লিউটিএর ভোলা অঞ্চলের বন্দর কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, লক্ষ্মীপুরের রহমতখালী চ্যানেলে গত একযুগ ধরে বহুবার খনন কাজ হয়েছে। কিন্তু আশানুরূপ ফল মেলেনি। তিনি বলেন, একদিকে খনন হচ্ছে, আরেক দিকে পলি পড়ছে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, এ খালের মধ্যে দুটি জলকপাট প্রায় সময় বন্ধ থাকে। আশপাশে খননকৃত মাটি-বালু ফেলার স্থান না থাকায় দূরের নদীতে ফেললে আবার জোয়ারে ভেসে আসে।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানান, ডুবোচরের স্থানগুলো চিহ্নিত করে খুব শীঘ্রই এগুলো অপসারণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া হবে। পাশাপাশি এবার শীত মৌসুমের শুরুতেই এখানকার নদ-নদীর ডুবোচর খনন করে নাব্যতা ফেরাতে সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন-নৌ পরিবহন সংশ্লিষ্টরা।