আগামীকাল ভোলা হানাদার মুক্ত দিবস

বাসস
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৫:৫৪
ছবি : বাসস

 আল-আমিন শাহরিয়ার

ভোলা, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫ (বাসস): আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর দক্ষিণ গাঙ্গেয় দ্বীপের জেলা ভোলা পাক হানাদার বাহিনী মুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে ভোলা পাক হানাদার মুক্ত হয়। ১৬ ডিসেম্বর সারা দেশ স্বাধীন হলেও ভোলা স্বাধীন হয়েছিলো তারও আগে ১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। আর বিজয়ের এই দিনে লাল সবুজের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে রাস্তায় নামে ভোলাবাসী। 

ভোলার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাঠে জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপের মুখে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। নিজেদের জীবন বাঁচাতে ১০ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী কার্গো লঞ্চ যোগে ভোলা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তাদের চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হয় ভোলা।

পাকবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার পর ১০ ডিসেম্বর সকালে বর্তমান ভোলা কালেক্টরেট ভবনের সামনের জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের ছাদে পতাকা উড়িয়ে ভোলাকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন মুক্তিযোদ্ধারা। পাকবাহিনী চলে যাওয়ার পর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা আশপাশ থেকে শহরে প্রবেশ করেন। শহরের ওয়াপদা, পাওয়ার হাউজ ও পরবর্তীতে জেলা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ক্যাম্প স্থাপন করে এবং শুরু হয় বিজয়ের আনন্দ মিছিল।

১৯৭১-এ দেশ রক্ষায় সারাদেশের ন্যায় ভোলাতেও চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ভোলা সরকারি স্কুল মাঠ, বাংলা স্কুল, টাউন স্কুল মাঠ ও ভোলা কলেজের মাঠের কিছু অংশে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্মুখযুদ্ধ হয় ভোলার ঘুইংঘারহাট, দৌলতখান, বাংলাবাজার ও বোরহানউদ্দিনের দেউলা এবং চরফ্যাশন বাজারে।

বিপুল সংখ্যক পাক সেনাকে হটিয়ে যুদ্ধে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শাহাদাত বরণ করেন। ভোলার খেয়াঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারের ধরে এনে হত্যা করে তেঁতুলিয়া নদীতে ফেলে দেয়া হত। ওইসময় মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষের রক্তে লাল হয়ে যেত মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীর লোনা পানি।

এছাড়া বহু নারীকে ধরে এনে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আটকে রেখে রাতভর নির্যাতনের পর সকালে লাইনে দাঁড় করিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হত। ওই সময় হানাদার বাহিনী অগণিত মানুষসহ মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করে গণকবর দিত।

পাকসেনারা পালিয়ে যাওয়ার পর ভোলার ওয়াপদা থেকে ৩০ জন বীরঙ্গনাকে উদ্ধার করা হয়। চিকিৎসা শেষে পরিবারের কাছে তাদের পৌঁছে দেয়া হয়।

আরো জানা যায়,স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভোলা শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড অফিস চত্বর দখল করে পাক-হানাদার বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। সেখান থেকে চালায় নানান পৈচাশিক কর্মকাণ্ড। মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী নিরীহ মানুষদের ধরে এনে হত্যা করা হয়। ওয়াপদা ভবনের পেছনে গণকবর দেয়া হয়। সেটি এখন বধ্যভূমি। এছাড়াও ভোলার বাংলা বাজারে ১৯৭১ সালের ২৭ অক্টোবর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মুখযুদ্ধ হয়। এসময় অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। 

ওই সময় ভোলা সদরের গুইংগারহাট, দৌলতখানের গুপ্ত বাজার, বোরহানউদ্দিনের দেউলাতে বিরামহীন সম্মুখযুদ্ধ হয়। এসব বধ্যভূমি ও সম্মুখযুদ্ধের রণাঙ্গনের স্থানগুলোর মধ্যে শুধু মাত্র ভোলার পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বধ্যভূমি ও বাংলা বাজারে মুক্তিযুদ্ধের স্থান সংরক্ষণ করা হয়েছে। এছাড়া ভোলা বাংলা বাজারে মুক্তিযুদ্ধের স্থান সংরক্ষণের কাজ হলেও অন্যান্য বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলো এখনো সংরক্ষণ করা হয়নি। 

মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয় মানুষেরা বধ্যভূমি ও মুক্তিযুদ্ধের স্থানগুলো সংরক্ষণের দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের প্রতি।

একাত্তরের ১০ ডিসেম্বর হানাদার মুক্ত হয় ভোলা। শক্রমুক্ত ভোলায় হাজারো মুক্তিকামী মানুষ সেদিন রাস্তায় নেমে আনন্দ উল্লাস করেন। ১৯৭১ সালের এইদিনে সকাল ১০টার দিকে ভোলার লড়াকু সন্তানরা তখনকার ভোলা মহকুমার এসডিও অফিস বর্তমান জেলা হিসাব রক্ষণ অফিসের ছাদে উঠে পাকিস্তানের পতাকা পুড়িয়ে উড়িয়েছিলেন লাল সবুজের স্বাধীন বাংলার জাতীয় পতাকা।

মুক্তিযোদ্ধারা ভোলার অধিকাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যখন শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রস্তুতি নেন, ঠিক সেই সময় ১০ ডিসেম্বর ভোররাতে পাকিস্তানি হানাদাররা চারদিকে গুলি ছুড়তে থাকে। তখন মুক্তিযোদ্ধা কাজী জয়নাল ও ফিরোজের নেতৃত্বে ১৩ জনের একটি বাহিনী তাদের পেছন থেকে ধাওয়া করলে হানাদাররা ভোর ৫টায় ভোলার পুরান লাশ কাটা ঘরের পাশে রাখা একটি কার্গো লঞ্চে চড়ে ভোলা থেকে পালিয়ে যায়। ওই সময় তাদের গতিরোধ করার জন্য খালে গাছ ফেলে ব্যারিকেডও দিয়েছিল মুক্তিকামী জনতা।

পাক হানাদারদের বহনকারী ওই কার্গো লঞ্চটি মিত্রবাহিনীর বোমা বর্ষণের ফলে চাঁদপুরের মেঘনায় ডুবে হানাদার বাহিনীর অধিকাংশ সদস্যের মৃত্যু ঘটে বলে জানা যায়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আলম নিরব জানান, ১৯৭১ সালের ৬ মে দুপুর ১২ টায় বরিশাল থেকে লঞ্চযোগে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভোলার খেয়াঘাটে এসে নামে। এ সময় তৎকালীন ভোলা পৌরসভার চেয়ারম্যানসহ শহরের একটি গ্রুপ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে স্বাগত জানিয়ে শহরে নিয়ে আসে। খেয়াঘাট থেকে সবাই পায়ে হেঁটে ভোলার যুগিরঘোল নামক এলাকার ওয়াপদা কলোনীতে গিয়ে পৌঁছে। এ খবর ছড়িয়ে পড়তে না পড়তে শহরের প্রায় সব বাড়িঘর ফাঁকা হয়ে যায়। এদিকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ট্রাক নিয়ে শহরের রাস্তায় রাস্তায় টহল দিতে থাকে। 

ভোলা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের বর্তমান সদস্য সচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মাহফুজুর রহমান বাসসকে জানান, ভয়াল সেই মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রতি রাতেই স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় হানাদার বাহিনী বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকজন ধরে নিয়ে আসত। বিশেষ করে নারী ও যুবকরাই তাদের শিকারে পরিণত হত। এদের নানান অত্যাচার নির্যাতন করে মেরে ফেলে ওয়াপদার পূর্ব দিকের দেয়ালের বাইরে পুতে ফেলত। সন্ধ্যার পরে ট্রাকে করে লোকজনকে ভোলা খেয়াঘাট নিয়ে গুলি করে নদীতে ফেলে দিত বর্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

এদিকে আগামীকাল ১০ ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদায় দিবসটি পালনে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বর্ণাঢ্য র‌্যালি, আলোচনা সভাসহ বিভিন্ন কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রোকেয়া দিবস পালিত
রাশিয়াকে ভূখণ্ড ছেড়ে দেওয়ার কোনো অধিকার নেই কিয়েভের : জেলেনস্কি
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস উদ্‌যাপনে জাতীয় কর্মসূচি ঘোষণা
রংপুরে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় বেগম রোকেয়াকে স্মরণ, জন্ম-মৃত্যুদিবসে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি
৭ দেশের প্রবাসীদের জন্য বৈদেশিক ঠিকানা সংশোধনের সময় বাড়ালো নির্বাচন কমিশন
পিরোজপুরে সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশ সুপারের মতবিনিময়
প্রধান বিচারপতির বাসভবন ও আশপাশের এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ: ডিএমপি 
করদাতাদের বার্ষিক রিটার্ন দাখিল ব্যাংকের সঙ্গে সমন্বয়ে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করছে এনবিআর
চট্টগ্রামে মহিউদ্দিন হত্যা মামলার পলাতক আসামি ডিউক গ্রেফতার
কোরিয়ার সহায়তায় ঢাকা কেন্দ্রিক নদীগুলোর পানির মান পর্যক্ষেণ করবে সরকার
১০