বাসস
  ০৭ মার্চ ২০২৩, ১৭:৫৬
আপডেট : ০৭ মার্চ ২০২৩, ২৩:৫৭

দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে: বিশেষজ্ঞদের অভিমত

॥ মাহফুজা জেসমিন ॥
ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০২৩ (বাসস): দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। মনো-সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণে বাংলাদেশের মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষায় অংশগ্রহণ কম দেখা যায়। এমনকি উচ্চশিক্ষিত, সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সঙ্গে যুক্ত অভিভাবকগণও কন্যা সন্তানদের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে যুক্ত করতে চাইলেও, বিজ্ঞানে যুক্ত করতে চান এমন অভিভাবক খুঁজে পাওয়া কঠিন। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিকস এন্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক লাফিফা জামাল বাসসকে বলেন, আর্থ-সামাজিক কারণে বিজ্ঞান শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ কম দেখা যায়। বেশিরভাগ অভিভাবক মেয়েদের পড়ালেখার পেছনে অপেক্ষাকৃত কম খরচ করতে চান। যেহেতু বিজ্ঞান বিষয়ক পড়ালেখায় খরচ বেশি, তাই মেয়েদের বিজ্ঞান পড়ানোর আগ্রহ অভিভাবকদের মধ্যে কম। 
রোবোটিকস এন্ড মেকাট্রনিকস প্রকৌশল বিভাগের সাবেক বিভাগীয় প্রধান ড. লাফিফা জামাল বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য ২০২২ সালে “উইমেন আইসিটি পার্সোনালিটি অব দ্যা ইয়ার ২০২২” অর্জন করেন। বিজ্ঞান শিক্ষায় নারীদের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ১৯৯৫ সালে আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে অনার্সে ভর্তি হই তখন আমিই প্রথম এবং একমাত্র মেয়ে শিক্ষার্থী ছিলাম। তবে, পরে আরো তিনজন অন্য বিভাগ থেকে এসে এই বিভাগে এসে ভর্তি হন।    
তিনি বলেন, এখন অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। এই শতাব্দিতে এসে বিজ্ঞান শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ  বেড়েছে এবং তারা বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সাফল্যের সঙ্গে কাজ করছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি  দেশে ও দেশের বাইরে বিজ্ঞান ও গবেষণায় নারীর অবদানের চিত্র তুলে ধরেন। 
বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেট-এর সমীক্ষায় বিশ্বসেরা ১০ জন অণুজীব বিজ্ঞানীর মধ্যে একজন বাংলাদেশের তরুণী সেঁজুতি সাহা। তিনি শুধু নিজের জীবনেই বিজ্ঞানের চর্চ্চা করেন না। তিনি শিশুদের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চ্চা বাড়াতেও কাজ করছেন। তার পরিচালিত চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন থেকে পরিচালিত বিজ্ঞান বিষয়ক এই কর্মসূচির নাম, ‘গড়বো বিজ্ঞানী, সাজাবো বাংলাদেশ’। বিজ্ঞান ও মানুষের মধ্যেকার ব্যবধান কমিয়ে আনাই যার লক্ষ্য। 
এর আগে কোভিড-১৯ মহামারির সময় সেঁজুতি সাহার নেতৃত্বে বাংলাদেশের একদল তরুণ বিজ্ঞানী বাংলাদেশে প্রাপ্ত নতুন করোনা ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স শনাক্ত করেন। এছাড়াও তিনি শিশুদের মেনিনজাইটিস, চিকনগুনিয়া এবং পোলিও নিয়ে কাজ করেছেন।
সেঁজুতি সাহা বাসসকে বলেন, “ধীরে ধীরে পরিবর্তন হলেও প্রেক্ষাপট এখনও ততটা বদলায়নি। সমাজে অনেক পরিবর্তন আসছে। মেয়েরা বাইরে যাচ্ছে। বাইরে কাজ করছে। কিন্তু, তাতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েদের দুটো জায়গাই সামলাতে হয়।”
তিনি বলেন, “যখন একজন নারীকে দুটো জায়গাই সামলাতে হয় তখন কিন্তু কোন অবস্থাতেই সে একজন পুরুষের সমান কাজ করতে পারবে না। কারণ, মেয়েটা তো তখন ব্যালেন্স করছে। কমপ্রোমাইজ করছে। এডজাস্ট করছে। আর সায়েন্স বা গবেষণার কথা যদি বলি, তাহলে এখানে মেয়েরা আরেকটু পিছিয়ে আছে। কারণ, রিসার্চ ওয়ার্কটা নয়টা-পাঁচটার চাকরি নয়। রিসার্চ ধারণ করতে হয় মনের মধ্যে। দিন রাত চিন্তা করতে হয়। একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে হলে ল্যাব ওয়ার্ক করতে হয়। ল্যাব ওয়ার্ক পাঁচটায় শেষ নাও হতে পারে। পাঁচটার কাজ সাতটায়ও শেষ হতে পারে। সাতটার টা ন’টা হতে পারে। ন’টা এগারোটা হতে পারে। অফিসে ল্যাব করেই বাড়িতে গিয়ে আমি আমার মনটাকে চেঞ্জ করে রান্না বান্না করলাম। এটাও সম্ভব নয়। কারণ, গবেষণাটা সারাক্ষণ মাথায় রাখতে হয়।”
সেঁজুতি বলেন, বিজ্ঞান ও গবেষণায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে হলে ঘরে-বাইরে নারী-পুরুষকে সমানভাবে কাজটা ভাগ করে নিতে হবে। যতদিন না নারীরা পুরুষের সাথে সমান সমান ভাবে কাজ করার সুযোগ পাবে ততদিন পর্যন্ত নারীদের বেশি সাপোর্ট দিতেই হবে। আমরা তো এখন একটা লেভেল ফিল্ড এ আছি। ছেলেরা তো অনেক দিন ধরে কাজ করছে। কাজেই নারী-পুরুষের মাঝখানে ব্যবধানটা কমিয়ে আনতে হলে নারীদের প্রতি অনেক বেশি এটেনশন দিতে হবে।   
যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা আয়োজিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় হ্যাকাথন প্রতিযোগিতা নাসা স্পেস অ্যাপস চ্যালেঞ্জের ‘মোস্ট ইন্সপিরেশন’ ক্যাটাগরিতে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশের দল ‘টিম ডায়মন্ডস’। যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত ‘২০২২  গ্লোবাল উইনার্স’ অনুষ্ঠানে ১০টি ক্যাটাগরিতে গ্লোবাল চ্যাম্পিয়ন দলের নাম ঘোষণা করে নাসা। এই দলের দলনেতা একজন তরুণী ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী টিসা খন্দকার। তার দলের অন্য চারজনের মধ্যে একজন মেয়ে এবং তিনজন ছেলে। 
টিম ডায়মন্ডস দলটি মহাকাশের বিভিন্ন রহস্য নিয়ে তৈরি ‘ডায়মন্ড ইন দ্য স্কাই’ ইন্টারঅ্যাকটিভ গেম তৈরি করে প্রতিযোগিতায় গ্লোবাল চ্যাম্পিয়নের স্বীকৃতি পেয়েছে। শিশুদের জন্য তৈরি এই গেমটি খেলার ছলে শিশুদের মহাকাশের বিভিন্ন রহস্য জানার সুযোগ করে দেয়।
তিন রোবটবিদ কন্যার মা ডা. সৈয়দা মোমেনা আফসানা বাসসকে বলেন, বাংলাদেশে সার্বিক শিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বলে বিজ্ঞান শিক্ষায়ও গত দশ বছরে মেয়েদের অংশগ্রহণ বেড়েছে, যা  পুরুষদের তুলনায় অনেক কম। তবে, বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার এখনও অনেক বেশি। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখনও সমাজে মেয়েদের ব্যাপারে একটা ধারণা রয়েছে যে মেয়েরা শুধু কোমল কাজগুলো করবে। যন্ত্রপাতি নিয়ে তাদের কাজ করার দরকার কি? এই ট্যাবু ভাঙতে হবে। তিনি বলেন, সমাজের এই ট্যাবু ভাঙার জন্য মায়েদেরই এগিয়ে আসতে হবে। কারণ, যুদ্ধটা যখন নারীর, তখন সে যুদ্ধ নারীকেই জয় করতে হবে। পুরুষরা সেটা করে দেবে না। 
ডা. মোমেনা বলেন, নাচ, গান, আবৃত্তি বা ছবি আাঁকার মতো প্রযুক্তিও যে বাচ্চাদের শখ হতে পারে সেটা মানতে বোধ করি আমাদের আরো অনেক সময় লাগবে। তবে, এখন মানুষের চিন্তা বদলাচ্ছে। বাচ্চারা যদি সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড না করে বিজ্ঞান অধ্যয়নে মনোযোগী হয় তাহলে তাদের সেই সুযোগই দেয়া উচিত। 
আইসিডিডিআর’বির ক্লিনিক্যাল বায়োকেমিস্ট্রি ল্যাবরেটরির দায়িত্বে কর্মরত এই মায়ের তিন কন্যাই রোবোটবিদ। ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে পৃথক পৃথকভাবে পদক জয় করেন। জাইবা মাহজাবীন এবং যাহরা মাহজারীন পূর্বালী চ্যালেঞ্জ গ্রুপে দুটো টেকনিক্যাল পদক এবং জুনিয়র গ্রুপে যারিয়া মুসাররাত পারিজাত  একটি স্বর্ণ ও একটি টেকনিক্যাল পদক অর্জন করে। 
বাংলাদেশ রোবোট অলিম্পিয়াডের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এবং আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডের কেন্দ্রীয় কমিটির একমাত্র নারী সদস্য ড. লাফিফা জামালের নেতৃত্বে ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের শিশু-কিশোররা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করছে এবং প্রতিবছরই পুরস্কার নিয়ে আসছে। ড. লাফিফা জামাল জানান, ২০১৮ সালে অংশগ্রহণকারী আটজনের মধ্যে দুইজন মেয়ে আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে, এবং ২০১৯ সালে ১৫ জন প্রতিযোগীর মধ্যে মেয়ের সংখ্যা ছিল পাঁচজন। ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেয়া ১৫ জন প্রতিযোগীর মধ্যে আটজনই মেয়ে। তাদের মধ্যে চারটি দল স্বর্ণপদক জয় করে। ২০২২ সালের আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী ১৪ জনের মধ্যে ৮ জন মেয়ে। ২০২২ সালে স্বর্ণ পদক জয়ী দলের তিনজনই মেয়ে (বয়স ১৩-১৮)।  
ড. লাফিফা জামাল বলেন, আন্তর্জাতিক রোবট অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণকারী অন্য কোনো দেশেরই এতোজন মেয়ে অংশগ্রহণকারী নেই। 
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ঘুরে দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান বিষয়ক বিভাগগুলোতে নারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। তবে, তা এখনও মোট সংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ।  বিজ্ঞান গবেষণায় নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধির চিত্র পাওয়া যায় বিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়েবসাইটে। আইসিডিডিআর’বি’র গবেষকদের তালিকা পর্যালোচনা করে কিছুটা ব্যতিক্রম লক্ষ্য করা যায়। এতে দেখা যায়, মোট গবেষকের এক তৃতীয়াংশ নারী।