বাসস
  ০১ আগস্ট ২০২৪, ১৭:০৩

রাজারবাগ হাসপাতালে সহিংসতার চিহ্ন নিয়ে কাতরাচ্ছে পুলিশ

॥ মহসিন বেপারী ॥
ঢাকা, ১ আগস্ট, ২০২৪ (বাসস) : রাজধানীর রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের ৯ তলায় পুলিশ ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন আদাবর থানায় কর্মরত পুলিশ কনস্টেবল রফিকুল ইসলাম শুয়ে কাতরাচ্ছেন। তার পুরো শরীরেই গুরুতর আঘাতের চিহ্ন,কোথাও কোথাও নীল হয়ে ফুলে ওঠা জখম। মাথা ও কানে মোট সেলাই পড়েছে ৪৭টি। ১৯ জুলাই সকাল ১০টায় তিনি আদাবর থানায় দায়িত্ব শেষ করে পায়ে হেঁটে কাচপুরের বাসায় সিভিল ড্রেসে ফিরছিলেন। যাত্রাবাড়ী থানাথীন কাজলা এলাকায় পৌঁছালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ৪-৫ জন তার পথ রোধ করে হাতে থাকা শপিং ব্যাগ চেক করে তার সরকারি ইউনিফর্ম দেখেই ‘পুলিশ পেয়েছি’ বলে মধ্যযুগীয় কায়দায় রড,লাঠি,হকিস্টিক দিয়ে নির্মমভাবে এলোপাথাড়ি পেটাতে থাকে। এক পর্যাযে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
বুধবার রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় এমনই মর্মস্পর্শী দৃশ্য।
রাজারবাগ কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতালের পরিচালক ডিআইজি শেখ মো. রেজাউল হায়দার বাসসকে জানান,এই হাসপাতালে বিভিন্ন ওয়ার্ডে ৩৭৪ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়ে ভর্তি হন। এর মধ্যে গুরুতর আহত ছিলেন ৮৯ জন, আইসিউতে ৪জন চিকিৎসা নিয়েছেন। এখানে চিকিৎসাধীন মাসুদ পারভেজ নামে একজন মারা গেছেন। এখনো এই হাসপাতালে ২৭ জন চিকিৎসা নিচ্ছেন। আগামী সপ্তাহে এখানে ১৭ জনের অপারেশন হবে। সব মিলিয়ে সারাদেশে সহিংসতায় ১ হাজার ১৩১ জন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য আহত হন।
এ আন্দোলনে প্রাণ হারান তিন পুলিশ সদস্য। তারা হলেন-ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের(ডিএমপি) প্রটেকশন বিভাগের নায়েক গিয়াস উদ্দিন,নারায়ণগঞ্জ পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই)পরিদর্শক মাসুদ পারভেজ ও ট্যুরিস্ট পুলিশের এএসআই মোক্তাদির।
রফিকুল ইসলামের পাশের বিছানায় চিকিৎসা নিচ্ছেন ট্রাফিক ওয়ারি জোনের পুলিশ সার্জেন্ট সৈয়দ মাসুদুর রহিম। তাঁর ভেঙেছে ডান হাত,মাথায় ১১টি সেলাই। ঘটনার দিনের দুঃসহ নৃশংস স্মৃতি বাসসের এই প্রতিবেদকের কাছে তুলে ধরতে গিয়ে হাসপাতালের বিছানায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আহত পুলিশ সার্জেন্ট রহিম।
তিনি বলেন,১৯ জুলাই সকালে ওয়ারিতে আমার স্পেশাল অন ডিউটি ছিল। ডিউটিতে যাওয়ার জন্য আমি আফতাব নগরের সি-ব্লকের বাসা থেকে বের হয়ে ই-ব্লকে পৌঁছলে আমাকে কয়েকজন আন্দোলনকারী পথ রোধ করে,তারা বলে সামনে যাওয়া যাবে না,আমি তাদের বললাম ভাই আমার তো ডিউটি আছে। তারা আমার ওপর ক্ষেপে গেল- এসময় আমি বিপদ বুঝতে পেরে মোটর সাইকেল ঘুরিয়ে বাসায় ফেরার চেষ্টা করলে কেউ একজন পেছন থেকে আমার মাথায় সজোরে আঘাত করে। পরে আমি মোটরসাইকেল থেকে নেমে দৌঁড়ে পাশের একটি ডাচবাংলা ব্যাংকে আশ্রয় নেওয়ার চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানের কলাপসিবল গেট বন্ধ থাকায় ভেতরে প্রবেশ করতে পারিনি। এসময় আন্দোলনকারীদের কেউ একজন আমার মাথার হেলমেট খুলে ফেলে এবং তারা আমাকে লোহার রড,বাঁশের লাঠি,হকিস্টিক দিয়ে এলোপাথারি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে তারা আমাকে গুরুতর আহত অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। পরে ব্যাংকের লোকজন আমাকে উদ্ধার করে। তারা যাওয়ার সময় আমার মোটরসাকেলটি পুড়িয়ে দেয়। খিলগাঁও পুলিশ ফাঁড়ির আরেক পুলিশ সদস্য মো. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ১৮ জুলাই রামপুরায় বাংলাদেশ টেলিভিশনের(বিটিভি) সামনে মতিঝিল জোনের ডিসি হায়াতুল ইসলাম স্যারের নেতৃত্বে আমরা দায়িত্ব পালন করছিলাম। আমরা রামপুরা ব্রীজ থেকে একটু এগিয়ে গেলেই আন্দোলনকারীরা ককটেল নিক্ষেপ করলে আমার বাম হাতে লেগে ঝলসে যায়। এসময় ইটের আঘাতে আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। এসময় আন্দোলনকারীরা আমাকে এলাপাথারি পেটাতে থাকে। আমার মাথায় ১৪ টি সেলাই লেগেছে। রামপুরায় ডিউটির সময় অনেক পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। কারো হাত ভেঙেছে,কারো চোখে ইটের আঘাত লেগেছে। ১৮ জুলাই রামপুরা বিটিভি ভবনের সামনে ডিউটি ছিল কনস্টেবল সোহেল মিয়ার। তিনি জানালেন- ‘আন্দোলনকারীরা এক পর্যায়ে তাদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমাকে হঠাৎ পেছন দিক থেকে হামলা করে এলোপাথারি মারতে থাকে। এসময় ওরা বলে পুলিশ পাইছি মার মার- একবারে মেরে ফেল’। আমি এক সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরে আমার সহকর্মীরা আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসে। আমার মাথায় ও হাতে ৪০টি সেলাই লেগেছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম এন্ড অপারেশনস) হারুন অর রশীদ বলেছেন,যারা পুলিশকে হত্যা করেছে,সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছে,স্বপ্নের মেট্রোরেলসহ সরকারি স্থাপনায় নাশকতা চালিয়েছে,যারা এসবের নেতৃত্ব দিয়েছে,অর্থ আদান-প্রদান করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। যেখানেই থাকুক না কেন তাদের কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।
ডিবি প্রধান বলেন,গত ২৮ অক্টোবরে আমরা রাষ্ট্রীয় স্থাপনা ও বিচারপতির বাসভবনে হামলার চিত্র দেখেছি। কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময়ও কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এর আড়ালে আমরা দেখলাম রাষ্ট্রীয় স্থাপনায় হামলা ও পুলিশকে টার্গেট করা হয়েছে। পুলিশ মারতে পারলেই ১০ হাজার টাকাও তারা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।