শিরোনাম
জি এম রাজিব হোসেন
ঢাকা, ২৭ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছর দেশে স্বৈরাচারী শাসনে জারি রাখা পতিত আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের গণ অভ্যুত্থানের সময় খোলা দেয়াল লিখন বা আঁকার একটি ফর্ম গ্রাফিতি একটি নান্দনিক প্রকাশভঙ্গি হিসাবে আবির্ভুত হয়েছিল।
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লব আরও বেশি গতি পায় এই গ্রাফিতির মাধ্যমে। প্রতিটি দেয়ালকে প্রতিবাদের ক্যানভাসে পরিণত করে, ক্ষোভ, হতাশা এবং বিদ্রোহের সাথে যুবকদের আশা-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করার সাথে সাথে এই গ্রাফিতি দেশে ক্ষোভ প্রকাশের হাতিয়ার হিসাবে আবির্ভূত হয়।
বিশেষ করে রাজধানী এবং অন্যান্য বিভাগীয় ও জেলা শহরের হাজার হাজার দেয়াল রং করার জন্য রং-তুলি হাতে নিয়েছিল বিপ্লবী ছাত্র-জনতা। এটি ছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিরুদ্ধে গণবিদ্রোহ প্রকাশের একটি শক্তিশালী প্রচেষ্টা।
প্রতিটি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাদ্রাসার ছাত্রদের সাথে গণতন্ত্রপন্থী মানুষ একত্রিত হয়ে রঙিন শিল্পকর্ম দিয়ে শহরের দেয়াল সজ্জিত করেছিল। এই গ্রাফিতিতে ছিল একটি শক্তিশালী বার্তা, যা ফ্যাসিবাদ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের মানুষ ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে একটি অনন্য এবং অসাধারণ গণ-অভ্যুত্থান দেখেছে, যা সহিংসতার প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও গুরুতর। যে আন্দোলনে জনগণের অংশগ্রহণ সবচেয়ে স্বতঃস্ফূর্ত বলে মনে হয়েছে।
গণ-অভ্যুত্থান মোকাবেলায় আওয়ামী লীগের নির্মমতায় আট শতাধিক মৃত্যু এবং বারো হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে। অথচ জেনারেল এরশাদের নয় বছরের স্বৈরাচারী শাসন, এমনকি স্বাধীনতা-পূর্ব দখলদার পাকিস্তানী শাসকের সময়ে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানেও এতো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
তবে আওয়ামী লীগের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড গণআন্দোলনকে দমন করতে পারেনি। কেননা দেশের বিপ্লবী ছাত্র-জনতা হাসিনা-বিরোধী আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য বৈচিত্র্যময় রাজনৈতিক কৌশল গ্রহণ করেছিল, যার ফলে গণঅভ্যুত্থানে গণ-অসন্তোষের রূপ হিসাবে গ্রাফিতির আবির্ভাব ঘটে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হওয়ায় দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতির ব্যবহার দেখা গেছে। ছাত্ররা মিছিল, সমাবেশ ও ধর্মঘটের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক কর্মসূচির পাশাপাশি কোটা নিয়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের অবস্থানের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভের একটি পদ্ধতি হিসেবে গ্রাফিতি এঁকেছিল।
তারা দেয়ালে ‘কোটা না মেধা, মেধা, মেধা’, ‘কোটা প্রথা নিপাত যাক, মেধাবীরা মুক্তি পাক’ অথবা ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাই নাই’ শিরোনামে গ্রাফিতি এঁকে তাদের মনের ভাব প্রকাশ করেছেন।
তবে আন্দোলনের শুরুতে গ্রাফিতি প্রতিরোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর এর ব্যবহার কিছুটা বেড়েছে। তারপর, সরকারি বাহিনী ও আওয়ামী লীগ ক্যাডারদের নৃশংস হামলার কারণে আন্দোলন যতই তীব্র হয়, ততই বাড়তে থাকে গ্রাফিতির ব্যবহার।
কোটা সংস্কার আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ায় একপর্যায়ে গত ১৮ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অনলাইন ও অফলাইনে গ্রাফিতি আঁকা ও দেয়াল লিখনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
আইননশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আওয়ামী লীগের অনুগতদের চোখ রাঙ্গানী উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা মহানগরীসহ দেশের প্রায় সর্বত্র কর্মসূচি পালন করে বিপ্লবী ছাত্র-জনতা।
স্বৈরাচারী সরকারের কঠোর পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ জনগণ শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রকাশের জন্য গ্রাফিতি বেছে নিয়েছে। তারা হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে তাদের দীর্ঘদিনের ঘৃণা প্রকাশ করেছে। প্রতিটি গ্রাফিতি প্রতিরোধের একটি স্ফুলিঙ্গ এবং লক্ষ লক্ষ বিদ্রোহী মনের উন্মোচনকারী হিসাবে আবির্ভূত হয়ে অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গণমানুষের আস্থায় পরিণত হয়।
গ্রাফিতি আঁকাকে একটি অবৈধ কাজ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও বিপ্লবীরা বিভিন্ন সময়ে স্বৈরাচারী সরকারের অন্যায়, ভুল বিচার, অপশাসন এবং দুর্নীতির প্রতিবাদ করার জন্য দেয়ালের খোলা ক্যানভাস বেছে নিয়েছে। তারা দেয়ালে গ্রাফিতি এঁকেছে। অনেকের মতে এটা ‘রাস্তার শিল্প’।
বাংলাদেশেও অনেক আগে থেকেই বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে গ্রাফিতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। দেশের মানুষ ১৯৫২, ১৯৭১ এমনকি ১৯৯০ সালে মতামত প্রকাশের জন্য গ্রাফিতি ব্যবহার করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের আন্দোলনকারীরা আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের বিরুদ্ধে নীরব শৈল্পিক অভিব্যক্তি হিসাবে গ্রাফিতি ব্যবহার করেছে।
কিছু আইকনিক গ্রাফিতি যেমন ‘পানি লাগবে পানি’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা, দেশটা করো বাপের না’ ‘চাইতে গেলাম অধিকার, হয়ে গালাম রাজাকার’, হামার ব্যাটাক মারলু কেন’, ‘বুলেট দিয়ে বিপ্লব থামে না’ এবং ‘একাত্তরে দেশ লাভ, ২০২৪-এ পূর্ণ স্বাধীনতা লাভ’, ইত্যাদি স্পষ্টতই ছিল নিপীড়ক আওয়ামী লীগ শাসনের বিরুদ্ধে চরম ক্ষোভ ও অবমাননা।
সমাজের বিবেকবান মানুষের মতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে ২০২৪ সালের এই গ্রাফিতিগুলো বিদ্রোহের উত্তরাধিকার বহন করবে।