বাসস
  ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:০৯
আপডেট : ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২২:৪৮

নিষেধাজ্ঞার জাহাজ ইস্যুতে রাশিয়ার সাথে সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না : ঢাকার প্রত্যাশা

ঢাকা, ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ (বাসস) : বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ বলেছে, ঢাকা বিশ্বাস করে যে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে একটি রুশ জাহাজের বিষয়ে বাংলাদেশের সিদ্ধান্ত মস্কোর সাথে বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে প্রভাবিত করবে না। এক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেছেন, ‘আমাদের (ঢাকা-মস্কো) বোঝাপড়া এত ভাল যেকারনে আমরা মনে করি না যে, একটি একক সমস্যা বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’  
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেহেলি সাবরিন ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মস্কোর অমূল্য সমর্থনের কথা স্মরণ করে রাশিয়াকে বাংলাদেশের ‘পরীক্ষিত এবং দীর্ঘমেয়াদী বন্ধু’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে বারবার রাশিয়ার ভেটোর কথা স্মরণ করেন, যা গৃহীত হলে  বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করে তুলত। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় রুশ জাহাজের প্রবেশ বন্ধ করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে রাশিয়া মস্কোতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত কামরুল আহসানকে তলব করার দুই দিন পর, বাংলাদেশের এই আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া এলো।
সাবরিন বলেন, রাশিয়ার জাহাজ সংক্রান্ত বিষয়টি ছয় সপ্তাহের পুরনো হলেও চলতি সপ্তাহে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডাকা হয়েছে। কেন বাংলাদেশ তার বন্দরে মার্কিন-নিষেধাজ্ঞাভুক্ত রুশ জাহাজকে নিষিদ্ধ করেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা একটি বাণিজ্য নির্ভর দেশ’। এ জন্য বাংলাদেশ সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে পছন্দ করে। তিনি বলেন, শুধু বাংলাদেশ নয়, নিষেধাজ্ঞাভুক্ত রাশিয়ার জাহাজকে অন্যান্য দেশের বন্দরেও ভেড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েেেছ।
এর আগে বুধবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, যে বিষয়ে রাষ্ট্রদূতকে সেখানে ডাকা হয়েছিল, সে সম্পর্কে তারা রাষ্ট্রদূতের কাছে একটি বিশদ প্রতিবেদন চেয়েছে। রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে ঠিক কী আলোচনা হয়েছে, তা জানাতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের রাষ্ট্রদূত তার প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন, এখন এখানে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এটি বিশ্লেষণ করছে। প্রতিবেদনটি পরীক্ষা করার পরে বৈঠকের বিষয়ে আরও তথ্য প্রকাশ করা হবে’।
২১ ফেব্রুয়ারি রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি পরবর্তী বিবৃতিতে বলেছে, তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বলেছে যে তাদের জাহাজ নিষিদ্ধ করার পদক্ষেপ ‘ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়, এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্ভাবনায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।’ রুশ পররাষ্ট্র দপ্তর বলেছে, ‘এই পদক্ষেপটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ঐতিহ্যগতভাবে বন্ধুত্বপূর্ণ চরিত্রের বিপরীতে যায় এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের সহযোগিতার সম্ভাবনার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।’ 
সাবরিন বলেন, রাশিয়ার উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী রুডেনকো আন্দ্রে ইউরেভিচ বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন, কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে ঐতিহাসিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিবেচনায় নেওয়ার জন্য ঢাকাকে অনুরোধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তিনি (রাশিয়ার জুনিয়র মন্ত্রী) বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতকে বিষয়টি নিয়ে  রাশিয়ার উদ্বেগ ঢাকার উচ্চপদস্থদের কাছে জানানোর জন্য অনুরোধ করেছেন’। সাবরিন বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অধীনে ৬৯টি রুশ জাহাজ নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে ঢাকার সিদ্ধান্তের প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করেছেন। মহামারী এবং রাশিয়া-ইউক্রেন দ্বন্দের কারণে বর্তমান অর্থনৈতিক পতনের বিষয়ে রাষ্ট্রদূত ইউরেভিচকে ঢাকার উদ্বেগের কথাও জানানো হয়।
বাংলাদেশ রাষ্ট্রদূতকে তলব করার আগে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা মস্কোতে গণমাধ্যমকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেকেন্ডোরি স্যাংশনের নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে বাংলাদেশ রাশিয়ার জাহাজটিকে নিষিদ্ধ করেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা তাস তাকে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘আমরা জানি যে এই বন্ধুত্বপূর্ণ পদক্ষেপটি দেশটির কর্তৃপক্ষ তাদের নিজস্ব উদ্যোগে নেয়নি। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৌণ নিষেধাজ্ঞার হুমকির মধ্যে তৈরি করা হয়েছিল।’ 
ঢাকা গত জানুয়ারি মাসে মস্কোকে জানিয়েছিল যে, তারা বাংলাদেশের বন্দরে নিষেধাজ্ঞাভুক্ত জাহাজ ছাড়া অন্য কোনো জাহাজ পাঠাতে পারে। বাংলাদেশের ব্যবসায়ী নেতারা এর আগে বলেছিলেন যে, দক্ষিণ এশিয়ার এই ছোট দেশটি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে রুশ জাহাজ বা পণ্যের উপর মার্কিন বা ইইউ নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করতে পারে না, কারণ এর ফলে দেশটি অভিন্ন নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে পারে। বাংলাদেশের মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস এর আগে একটি নোটিশে জানিয়েছিল যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুসারে তারা যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা ৬৯টি রুশ জাহাজের বাংলাদেশী বন্দরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। বাংলাদেশ ওশেন গোয়িং শিপ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিওজিএসএ) চেয়ারম্যান আজম জে চৌধুরী বলেন, “রাশিয়া একটি বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ, কিন্তু তারা যাই বলুক না কেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞার অধীন তাদের নির্দিষ্ট জাহাজগুলোকে প্রবেশ করতে দিতে পারি না।” তিনি বলেন, তৈরি পোশাকের মতো বাংলাদেশী পণ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য এবং “আমাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ কারণেই আমরা তাদের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে পারি না”। চৌধুরী আরো বলেন, “বাস্তবতা হল এই যে আমাদের প্রতিবেশী ভারতসহ বেশিরভাগ দেশও নিষেধাজ্ঞা মেনে নিয়েছে। পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার অধীনে জাহাজগুলিকে প্রবেশ করতে না দেয়ার অর্থ এই নয় যে, বাংলাদেশ রাশিয়ার সাথে তার বাণিজ্য সম্পর্ক ছিন্ন করছে”।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন গত মাসে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক নিষেধাজ্ঞার অধীন জাহাজের মাধ্যমে পণ্যবাহী মালামাল না পাঠানোর জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, ঢাকা চায় না ওয়াশিংটনের সাথে তার সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হোক। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা রাশিয়াকে বলেছি যে, তারা (মার্কিন) নিষেধাজ্ঞার অধীনে থাকা ৬৯টি জাহাজ ছাড়া তাদের যেকোনো জাহাজের মাধ্যমে আমাদের কার্গো পাঠাতে পারে।” রাশিয়ার প্রযুক্তি ও সহায়তায় নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য মস্কো গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে একটি জাহাজ পাঠিয়েছিল । মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ঢাকা জাহাজটি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিল। রাশিয়ান পতাকাবাহী জাহাজ -স্পার্টা থ্রি -  বঙ্গোপসাগরে তার আঞ্চলিক জলসীমায় পৌঁছানোর পর, ২৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে মংলা বন্দরে কার্গো আনলোড করার কথা ছিল।
মোমেন বলেন “এটা অবাক করার বিষয় যে, রাশিয়া একটি জাহাজের নাম পরিবর্তন করেছে। আমরা এটা আশা করিনি। এখন আমরা আশা করি, রাশিয়া নিষেধাজ্ঞাহীন জাহাজ পাঠাবে”।
এর আগে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে একটি চিঠিতে জাহাজটিকে প্রকৃতপক্ষে ইউআরএসএ মেজর বলে বর্ণনা করার পরে তা অস্বীকার করা হয়েছিল, যদিও এটি নিষেধাজ্ঞভুক্ত রাশিয়ান জাহাজের তালিকায় ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৬৯টি অনুমোদিত রাশিয়ান জাহাজের তালিকা অনুসারে, ইউআরএসএ মেজর বা স্পার্টা থ্রি হল একটি উভচর/আক্রমণকারী কার্গো জাহাজ (একেএ) যা সরঞ্জাম, পণ্যসম্ভার এবং সৈন্য বহন করার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।