বাসস
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:৩৯

গণঅভ্যুত্থানের ওপর সাংবাদিক ডালিমের লেখা বই জুলাই বিপ্লবের ঐতিহাসিক দলিল

গণঅভ্যুত্থানের ওপর সাংবাদিক ডালিমের লেখা বই জুলাই বিপ্লবের ঐতিহাসিক দলিল। ছবি: বাসস

ঢাকা, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): অনলাইন নিউজ পোর্টাল ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মেহেদী হাসান ডালিমের লেখা ‘হাইকোর্টের বিতর্কিত রায় ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান’ বইটি জুলাই বিপ্লবের ঐতিহাসিক দলিল।

বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ এ কথা বলেন।  প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচার বিভাগের ভূমিকা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এটি প্রথম গ্রন্থ।

সুপ্রিম কোর্টে প্রধান বিচারপতির দপ্তরে বইয়ের মোড়ক ২ জানুয়ারি উন্মোচন করা হয়। মোড়ক উন্মোচনের সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, এই বইটি জুলাই বিপ্লবের ঐতিহাসিক দলিল। বিচার বিভাগের ভূমিকা ও জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এটি প্রথম গ্রন্থ। এই উদ্যোগকে আমি শুভ সূচনা বলব। প্রধান বিচারপতি জুলাই বিপ্লব নিয়ে বই লেখায় সাংবাদিক মেহেদী হাসান ডালিমকে ধন্যবাদ জানান।

উচ্চ আদালতের এক রায়ে পাল্টে যায় ইতিহাস।

এই বইতে লেখক সাংবাদিক ডালিম একটি রায়কে কেন্দ্র করে ছোট আকারে শুরু হওয়া আন্দোলন কীভাবে গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল তা ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন। উচ্চ আদালতের কোটার পুনর্বহাল রায় ও আন্দোলনে গুলি না চালানোর রিটকে কেন্দ্র করে সুপ্রিম কোর্টের অন্দরমহলের নানান চাঞ্চল্যকর ঘটনা ও তথ্য তুলে ধরা হয়েছে বইটিতে।

সুপ্রিম কোর্টে নিয়মিত সাংবাদিক হিসেবে মেহেদী হাসান ডালিম নিয়মিত নানা প্রতিবেদনের পাশাপাশি নানা ধরনের প্রতিবেদন করেন।

তিনি বাসস’কে বলেন, ‘একটি রায় যে দেশের ইতিহাসই পাল্টে দিবে তখন কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। বলছি কোটা পুনর্বহাল করে হাইকোর্টের রায়ের কথা। এই রায় নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে শুনানি, আপিল বিভাগে প্রতিদিনের শুনানিতে আদালত কক্ষে উপস্থিত থেকেছি। মনোযোগ সহকারে শুনেছি, নোট নিয়েছি। রায় নিয়ে বিচারকদের ভূমিকা, রাষ্ট্রপক্ষের ভূমিকা, সরকার দলীয় আইনজীবীদের ভূমিকা নিজ চোখে দেখেছি। সুপ্রিম কোর্টের অন্দরমহলের নানান ঘটনা জানার সুযোগ হয়েছে। নিজ চোখে দেখা, নিজ কানে শোনা বিষয়গুলো এই বইয়ে তুলে ধরেছি।’

তিনি বলেন, বইয়ের পাতায় পাতায় লুকিয়ে আছে পাঠকের জন্য অনেক অজানা তথ্য। একজন গণমাধ্যম কর্মী হিসেবে, দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে শুরু থেকে আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেছি। আন্দোলন চলাকালে সুপ্রিম কোর্টের বাইরেও সংবাদ সংগ্রহের জন্য যেতে হয়েছে। তিনি বলেন, আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনগুলোতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, সায়েন্সল্যাব, শাহবাগ, যাত্রাবাড়ি এলাকার সংবাদ সংগ্রহ করেছি। বিশেষ করে যাত্রাবাড়ি এলাকার খবর সংগ্রহ করার সময় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালানোর নির্মম দৃশ্য নিজ চোখে দেখতে হয়েছে। গুলিবিদ্ধ লাশ নিয়ে সহকর্মীদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, লাশ নিয়ে আন্দোলনকারীদের মিছিল তো নিজ চোখে দেখা। এসব ঘটনাই তুলে ধরেছি।

চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন কীভাবে কোটি কোটি মানুষের আন্দোলেন পরিণত হলো, কীভাবে শেখ হাসিনা সরকার পতনের আন্দোলনে রুপ নিল, তারপর ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়া। এসব কিছু তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। বইতে সুপ্রিম কোর্টের বাইরের আন্দোলনের বর্ণনা ও তথ্যের জন্য বিভিন্ন পত্রিকা থেকে সহায়তা নিতে হয়েছে।

ডালিম বলেন, ‘আমি মনে করি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান নিয়ে যারা গবেষণা করতে চান, অধিকতর জানতে চান এই বই তাদের চেতনার খোরাক যোগাবে। আগামী দিনে যেকোনো ফ্যাসিবাদ বিরোধী আন্দোলনে তরুণ প্রজন্ম এই বই থেকে অনুপ্রেরণা লাভ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে।’

ডালিম কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায় নিয়ে বলেন, আমরা বিভিন্ন গণমাধ্যমের হয়ে দীর্ঘ সময় দেশের সর্বোচ্চ আদালত কাভার করি। সাধারণত কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে রিট হওয়ার পরপরই রিটকারী আইনজীবী বা রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বা আদালতের অন্য সূত্রে আমরা জেনে যাই। কিন্তু কোটা পদ্ধতি বাতিলের বৈধতা নিয়ে রায়, রুল, শুনানির খবর আমাদের কাছে ছিল অজানা। অনেকটা চুপিসারে রায়টি হয়ে গেল। এটি আমাদের কাছে রহস্যই থেকে যাবে।

তিনি বলেন, গত বছরের পাঁচজন বিকাল সাড়ে চারটার দিকে সুপ্রিম কোর্টে সহকর্মীদের সঙ্গে বসে গল্প করছিলাম। এমন সময় একজন সরকারি আইন কর্মকর্তা জানালেন হাইকোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছে। ২০১৮ সালে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ কোটা পদ্ধতি বাতিল করে যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল হাইকোর্ট সেই প্রজ্ঞাপন অবৈধ ঘোষণা করে রায় দিয়েছে। এ রায়ের ফলে চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসহ কোটা পদ্ধতি পুনর্বহাল হয়েছিলো। এ রায় গণমাধ্যমের কল্যাণে ছড়িয়ে পড়ার পর কোটা সংস্কার চেয়ে এবং ওই রায়ের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। তাদের শ্লোগান ছিল ‘কোটা নয় মেধা মেধা’। এরপর এ রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করলে আপিল বিভাগের চেম্বার কোর্টের তৎকালীন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম আদেশে বলেন, হাইকোর্টের রায় যেভাবে আছে সেভাবে থাকুক। হাইকোর্টের রায় স্থগিত করছি না। শুনানির জন্য আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে পাঠিয়ে দিচ্ছি। ২০২৪ সালের ৪ জুলাই  আপিল বিভাগের শুনানির জন্য রাখছি। ৪ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিষয়টি নিয়ে একপর্যায়ে বলেন, ‘এত আন্দোলন কিসের, রাস্তায় শুরু হয়েছে? চাপ দিয়ে কি রায় পরিবর্তন করবেন?  আন্দোলন করে রায় পরিবর্তন করতে পারবেন না।

এরপর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে ৬ বিচারপতির পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ হাইকোর্টের রায় বহাল রেখে আদেশ দেন। হাইকোর্টের রায় প্রকাশের পর রাষ্ট্রপক্ষকে লিভ টু আপিল করতে নির্দেশ দেন। ওই আদেশ নিয়ে অসন্তোষ দেখা যায়। আপিল বিভাগের আদেশ প্রত্যাখ্যান করে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচি ঘোষণা করে। ১১ জুলাই তড়িঘড়ি করে হাইকোর্ট সংক্ষিপ্ত রায় প্রকাশ করে। ১৪ জুলাই ২৭ পৃষ্ঠার রায় প্রকাশ করে হাইকোর্ট। বিষয়টি নিয়ে আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকে। ১৫ জুলাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন ছাত্রলীগই এ আন্দোলনের জবাব দেবে। এ বক্তব্যের পর ছাত্রলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। আওয়ামী  নেতাদের প্রত্যক্ষ উস্কানিতে শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন সহিংসতায় রূপ নেয়। ১৬ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে দেশের বিভিন্ন স্থানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ অন্তত ৬ জন নিহত হন। গুলিবিদ্ধ হয় চার শতাধিক।

ওইদিন গুলিতে আবু সাঈদসহ ৬ জন নিহত হন। এরপর দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। আন্দোলনের প্রতিটি ধাপের বিস্তারিত এই বইতে উল্লেখ রয়েছে।