ঢেঁকির সুরে বেঁচে থাকা গ্রামীণ ইতিহাস এখন শুধুই হারিয়ে যাওয়ার গল্প

বাসস
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৫, ১২:৫৪
গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি। ছবি: বাসস

\ বিপুল ইসলাম \

লালমনিরহাট, ২ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ‘ও ধান বানিরে, ঢেঁকিতে পাড় দিয়ে, ঢেঁকি নাচে, আমি নাচি হেলিয়া দুলিয়া, ও ধান বানিরে’-গ্রামবাংলার এ গান ঢেঁকির ঐতিহ্যকে মনে করিয়ে দেয়। একসময় গ্রাম বাংলার প্রতিটি জনপদে শোনা যেত এই জনপ্রিয় লোকগানটি। তখন কৃষিনির্ভর গ্রামীণ জীবনে ধান থেকে চাল, আর চাল থেকে আটা তৈরির একমাত্র উপায় ছিল ঢেঁকি। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো লালমনিরহাটের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ছিল এই ঐতিহ্যবাহী ঢেঁকি।

ঢেঁকিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল গ্রামীণ জীবনের নানা রীতি, সংস্কৃতি ও ছড়াগান। গ্রামের শিশুরা খেলতে খেলতে মুখে মুখে বলত-‘চিড়া কুটে খুকুরাণী, ছিটকে ওঠে ধান, শোভা বলে ওরে খুকু, আস্তে ঢেঁকি ভান। মুরগিগুলোর জ্বালায় বড় আসে বারে বারে, এইবার তাড়িয়ে দেব সাত সমুদ্র পাড়ে।’

এই ছড়া ও গানগুলো ঢেঁকিকে ঘিরে গড়ে ওঠা প্রাণবন্ত গ্রামীণ জীবনের চিত্র ফুটিয়ে তোলে। এখনও অনেকে হাস্যরসের ভঙ্গিতে বলেন, ‘ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে’— যা ঢেঁকির গুরুত্ব ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত। কালের বিবর্তনে আধুনিক প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির আগমনে ঢেঁকি এখন প্রায় হারিয়ে গেছে। তবু এটি আজও গ্রামীণ ঐতিহ্য, শ্রমনির্ভর জীবন এবং স্মৃতিময় অতীতের এক অমূল্য প্রতীক হিসেবে মানুষের মনে বেঁচে আছে।

জানা যায়, এক সময় গ্রাম-শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ঢেঁকি ছিল চাল বা আটা তৈরির একমাত্র মাধ্যম। নারীরা এটি চালাতেন, ধান ভেঙে চালের আটা তৈরি হতো এবং তা দিয়ে বানানো হতো পিঠা, পুলি ও পায়েস। আধুনিক যন্ত্রের আগমনের সঙ্গে ঢেঁকির ব্যবহার কমলেও, এটি নারীশ্রম ও বাঙালি সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে থেকে গেছে।

ইতিহাস থেকে জানা যায়, ঢেঁকি একটি প্রাচীন কাঠের যন্ত্র, যা মূলত ধান ও অন্যান্য শস্যের খোসা ছাড়ানোর কাজে ব্যবহার করা হতো। প্রাথমিকভাবে প্রাচীন ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রামীণ মানুষ মুসাল ও উদুখলার মতো সরঞ্জাম ব্যবহার করত শস্য ভাঙার জন্য। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই যন্ত্রটি উন্নতি পেয়ে ঢেঁকির রূপ নেয়। পরে এটি নেপাল, বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ওড়িশা অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং গ্রামীণ জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।

জেলা সদরের বড়বাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব আমবাড়ি গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ রাবেয়া খাতুন (৯২) বাসসকে বলেন, আগে ঢেঁকি ছিল সংসারের প্রাণ। ভোরে ঢেঁকির শব্দেই শুরু হতো দিনের কাজ। অনেক নারী ঢেঁকিতে শ্রম দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন।

একই এলাকার খরকি খাতুন (৮৪) বলেন, তখন ঘরে ঘরে ঢেঁকি ছিল। মেয়েরা একসঙ্গে বসে কাজ করত, গাইত গীত বা লোকগান। এখন আর সেই ঢেঁকির শব্দ শোনা যায় না।

সাহের বানু (৬২) বলেন, একসময় গ্রামের বহু নারী ঢেঁকি চালিয়ে সংসার চালাতেন, এখন তারা বেকার। আয়েশা (৫২) ও জাহেদা বেগম (৪৮) জানান, আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঢেঁকিতে ধান ভেনে পারিশ্রমিক হিসেবে চাল পেতেন, তবে ঢেঁকির তৈরি চালের মান ছিল অনেক ভালো। তাদের মতে, এখন সেই ঐতিহ্যের স্থান দখল করেছে রাইস মিল।

সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা ইয়াসিন আলী মোল্লা বলেন, আধুনিক প্রযুক্তি জীবনে এনেছে গতি ও স্বস্তি, তবে ঢেঁকির মতো ঐতিহ্যবাহী উপকরণ বিলুপ্তির পথে, যা ভবিষ্যতে হয়তো শুধু জাদুঘরেই টিকে থাকবে।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. সাইখুল আরেফিন বাসসকে বলেন, একসময় গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল ঢেঁকি। তবে প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এখন যন্ত্রই মানুষের শ্রম কমিয়ে এনেছে স্বস্তি ও গতি। ঢেঁকি হারালেও তার স্মৃতি আজও আমাদের ঐতিহ্যে জীবন্ত, যা মনে করায় অতীতের শ্রম, ঐক্য ও আত্মনির্ভরতার গৌরব।

গুণীজনদের মতে, ঢেঁকি ছিল গ্রামীণ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ও নারীশ্রমের প্রতীক। প্রযুক্তির অগ্রগতিতে এটি হারালেও ঐতিহ্য রক্ষায় ঢেঁকির ইতিহাস সংরক্ষণ জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের ওপর গণভোট চায় জামায়াত : ডা. তাহের
বিএনপির ৩১ দফা বাস্তবায়নে টাঙ্গাইলে গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ
প্রবাসীদের ভোটাধিকার দেয়ায় ইসিকে তারেক রহমানের ধন্যবাদ
বিনিয়োগ সহজীকরণে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে
গুপ্ত স্বৈরাচার ওত পেতে আছে, ঐক্যবদ্ধ হোন: তারেক রহমান
রাজধানীতে বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১৪
সরকার সকলক্ষেত্রে নারী উন্নয়নে গুরুত্ব দিচ্ছে: গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের ডিজি
নতুন ও সম্ভাবনাময় স্টার্ট-আপদের আইডিয়া প্রকল্পের কো-ওয়ার্কিং স্পেস ব্যবহারের আহ্বান ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবের
বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ মাদক কারবারি গ্রেফতার 
জনগণের সচেতনতা ও সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব: ডিএনসিসি প্রশাসক
১০