
রেদওয়ান আহমদ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৪ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস): দেশে এখন থেকে একই সঙ্গে আর্টিমিয়া ও লবণ উৎপাদন করা যাবে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের গবেষকরা আর্টিমিয়া ও লবণের সমন্বিত চাষের নতুন এই সম্ভাবনা উন্মোচন করেছেন। এতদিন এগুলো আলাদাভাবে চাষ করা হতো।
জানা যায়, আর্টিমিয়া এক ধরনের লবণজলীয় ক্ষুদ্র প্রাণী। এটি যা মাছ ও চিংড়ির পোনা উৎপাদনে অত্যন্ত পুষ্টিকর জীবন্ত খাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
গবেষকরা বলছেন, উপকূলীয় অঞ্চলের লবণ চাষীরা একই স্থানে একইসঙ্গে সমন্বিত পদ্ধতিতে আর্টিমিয়া এবং লবণ চাষ করে বেশি আয় করতে পারবেন। পাশপাশি আর্টিমিয়া বায়োমাস ও সিস্ট উৎপাদনে দেশের চাহিদা পূরণ হবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রাও সাশ্রয় হবে।
সমন্বিত আর্টিমিয়া চাষের মাধ্যমে আর্টিমিয়া বায়োমাস, সিস্ট, আটিমিয়া ফ্লেক ও গুণগতমান সম্পন্ন লবণ উৎপন্ন করা যায়। আর্টিমিয়া ফিল্টার ফিডার হিসেবে পানিতে দ্রবীভূত বর্জ্য আত্তীকরণ করে বিধায়, আর্টিমিয়া চাষে ব্যবহৃত লবণ পানি থেকে উৎপাদিত লবণ প্রচলিত পদ্ধতিতে উৎপাদিত লবণের চেয়ে অধিক পরিষ্কার ও অধিক গুণগত মানসম্পন্ন হয়।
গবেষকরা আশা করছেন, স্থানীয় পর্যায়ে এই পদ্ধতি ছড়িয়ে পড়লে বাংলাদেশ টেকসই মৎস্য উৎপাদনের পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় এবং ‘ব্লু ইকোনোমি’ বাস্তবায়নে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকল্প সম্পন্ন করে ‘মাঠ পর্যায়ে আর্টিমিয়া ও লবণ এর সমন্বিত চাষ সহায়িকা’ নামের সহায়িকা প্রকাশ করেন তারা। আর্টিমিয়া কী, কেন এটি চাষ করা দরকার, কীভাবে লবণের সঙ্গে একত্রে চাষ করলে উৎপাদন ও লাভ বাড়ে, এসব বিষয়ে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সেখানে।
মাঠ বা পুকুর প্রস্তুতি, আর্টিমিয়ার খাদ্য, বায়োমাস ও সিস্ট সংগ্রহ, লবণ উৎপাদন, ফ্লেক ফিড প্রস্তুত, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজারজাতকরণের ধাপও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে সহায়িকাটিতে।
মৎস্য অধিদপ্তরের ‘সাস্টেইনেবল কোস্টাল অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ প্রজেক্ট (এসসিএমএফপি)’ অর্থায়নে প্রকল্পটি শুরু হয় ২০২৪ সালের জুনে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ে মাঠ পর্যায়ের কাজ শেষ হয়।
প্রকল্পটির সার্বিক তত্ত্বাবধান করছেন মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মো. শফিকুল ইসলাম। গবেষণা দলে আরও রয়েছেন-ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আয়শা আক্তার, সহযোগী অধ্যাপক মুহাম্মদ মুস্তফা মনোয়ার, সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ নেছারুল হক, প্রভাষক মিঠু রঞ্জন সরকার ও আলম পারভেজ।
এছাড়াও গবেষণা সহকারী হিসেবে ছিলেন ওই বিভাগের ১০ শিক্ষার্থী। তারা হলেন- মো. নাফিজ মাহমুদ, এষা সালবীন, মারুফ আহম্মেদ, শাহরিয়া জাহান তিশা, নাহিল সরকার, তাসনিম আক্তার, রিকু রানী দেবী, মার্সি মীনাক্ষি ম্রং, ওমর হাসনাত ছিদ্দিক তন্ময় ও হোমায়রা আক্তার।
গবেষকরা বলছেন, আর্টিমিয়া ও লবণ চাষ হল একটি সমন্বিত কৃষি পদ্ধতি, যেখানে লবণ চাষের জমিতেই আর্টিমিয়া চাষ করা যায়। এই পদ্ধতি লবণ চাষীদের আর্থিক লাভকে বাড়িয়ে বিকল্প আয়ের পথ খুলে দেবে।
এতে একদিকে আমদানি নির্ভরতা কমবে, অন্যদিকে লবণ মাঠগুলোর বিকল্প ব্যবহার বাড়বে। ফলে এটি উপকূলীয় অঞ্চলে আয় বাড়াবে এবং টেকসই মৎস্যখাতে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে।
গবেষণা সহকারী আলম পারভেজ বলেন, দেশের কৃত্রিম মৎস্য, চিংড়ি প্রজনন ও উৎপাদন কেন্দ্রসমূহে আর্টিমিয়ার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। কিন্তু এর পুরোটাই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। লবণাক্ত পানিতে উৎপাদিত আর্টিমিয়া জীবন্ত অবস্থায় যেমন চিংড়ি কিংবা মাছকে খাওয়ানো যায়, তেমনি প্রাপ্তবয়স্ক আর্টিমিয়ার বায়োমাস ব্যবহার করে পরবর্তীতে খাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য আর্টিমিয়া ফ্লেক তৈরি করা যায়।
তিনি আরও জানান, উৎপাদিত আর্টিমিয়া ফ্লেক ও সিস্ট প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের মাধ্যমে সারাবছর ব্যবহার করা যায়। এ পদ্ধতিতে বছরব্যাপী উৎপাদন করতে চাইলে সাশ্রয়ী মূল্যে শেড নির্মাণ করে লবণ মাঠে সহজলভ্য প্রযুক্তিতে আর্টিমিয়া বায়োমাস, সিস্ট ও লবণ উৎপাদন করা সম্ভব।
অধ্যাপক আয়শা আক্তার বলেন, এই প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ছিল আর্টিমিয়া থেকে বায়োমাস ও সিস্ট উৎপাদন এবং সেই বায়োমাস থেকে আর্টিমিয়া ফ্লেক তৈরি করা, যা মাছ ও চিংড়ির পোনা উৎপাদনে ব্যবহার করা যাবে। পাশাপাশি চাষীদের আয় বৃদ্ধি এবং লবণের গুণগত মান উন্নয়ন।
তিনি বলেন, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সিস্ট, বায়োমাস ও ফ্লেক কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রগুলো সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সঙ্গে এগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে, কর্মসংস্থান বাড়বে এবং চাষীদের জীবনমান উন্নত হবে।
গবেষণা প্রকল্পের প্রধান অধ্যাপক ড. শফিকুল ইসলাম বলেন, এই গবেষণা প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের কাজ ২০২৫ সালের জুলাইয়ে শেষ হয়েছে। আর প্রশিক্ষণ, কর্মশালা ও প্রকাশনাসহ অন্যান্য কার্যক্রম অক্টোবরের মধ্যে শেষ করা হয়েছে। আমরা চাষীদের লবণমাঠেই আর্টিমিয়া ও লবণ একত্রে চাষের পদ্ধতি শিখিয়েছি। তারা লবণ, আর্টিমিয়া, বায়োমাস ও সিস্ট সংরক্ষণের পদ্ধতিও রপ্ত করেছে।
তিনি জানান, দেশের প্রায় ৭০০ কিলোমিটার উপকূলীয় এলাকায় সমন্বিতভাবে এই চাষ চালু করা গেলে এটি আমাদের ‘ব্লু ইকোনোমি’র লক্ষ্য পূরণে বড় ভূমিকা পালন করবে।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে অধ্যাপক শফিকুল বলেন, এখন আমাদের কাজ সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সম্পৃক্ত করা। এতে কৃষক ও লবণচাষীরা বাণিজ্যিকভাবে এই পণ্য বাজারজাত করতে পারবেন। কেউ গবেষণা করতে চাইলে বা ব্যবসায়িকভাবে যুক্ত হতে চাইলে আমরা সহযোগিতা করব।
তার আশা, সরকারি প্রণোদনা পেলে এবং দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর মতো স্থানীয় পর্যায়ে বায়োমাস, সিস্ট ও ফ্লেক উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়াতে পারলে এটি সম্ভাবনাময় শিল্পে পরিণত হবে।