বাসস
  ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২০:৩৮

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে বুলেট আঘাতপ্রাপ্ত লেলিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন

॥ রোস্তম আলী মন্ডল ॥
দিনাজপুর, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : দিনাজপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্টিল বুলেটের আঘাতে আহত পরিবহন শ্রমিক লেলিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন।
লেলিন বলেন, ‘আমার শরীরের স্টিল বুলেটের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে। চিকিৎসক অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে শরীর থেকে ৬টি বুলেট বের করেছে। শরীরের ক্ষতগুলো একদিন পরপর ড্রেসিং করতে হয়। ডেসিং এর সময় অনেক যন্ত্রণা হয়। খুব কষ্ট করে যন্ত্রনা সহ্য করতে হয়।’ 
আঘাতের ব্যথায় গত ৬৭ দিন রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারি না জানিয়ে তিনি বলেন, নিজে বুঝতে পারছি না কোনো দিন সুস্থ হয়ে উঠতে পারবো কি না? আবার স্বাভাবিক জীবনে চলাফেরা করতে পারবো কি না?  
গত রোববার বাসস প্রতিনিধির সঙ্গে কথা হয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিক্ষেপ করা স্টিল বুলেটের আঘাতে গুরুতর আহত পরিবহন শ্রমিক ও মহল্লা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক দিনাজপুর শহরে নিমনগর ফুলবাড়ী বাসস্ট্যান্ড মহল্লার খন্দকার মাজাহারুল ওমর লেলিনের (৪৮)। 
লেলিন বলেন, গত ১৮ জুলাই দুপুরে দিনাজপুর শহরে নিমনগর ফুলবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকার বাসা থেকে অটোবাইক যোগে শহরে কালিতলা তার কর্মস্থল রোজিনা এন্টারপ্রাইজ কোচ কাউন্টারে যাচ্ছিলেন। পথের মধ্যে শহরের মডার্ন মোড় এলাকায় বৈষময়বিরোধী আন্দোলনের সময় রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লেলিন অটেবাইক থেকে নেমে পায়ে হেঁটে রওনা দেন। 
তিনি জানান, কিছুদূর যাওয়ার পর শহরের চারু বাবুর মোড়ে পৌঁছলে; অতর্কিতভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী স্টিল বুলেট, রাবার বুলেট ও টিয়ারসেল  বৃষ্টির মত নিক্ষেপ করতে থাকে। লেলিন কিছু বুঝে ওঠার আগেই  দৌড় দিয়ে তার কর্মস্থল শহরের কালিতলা রোজিনা এন্টার এন্টারপ্রাই কোচ কাউন্টারে যাওয়ার চেষ্টা করে। কোচ কাউন্টার যাওয়া পর্যন্ত তার শরীরে বেশ কিছু স্টিল বুলেট ও রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়। 
কোচ কাউন্টারে থাকা তার সহযোগীরা তাকে গুরুতর অবস্থায়  ভিন্ন পথে ভ্যান যোগ তার বাড়িতে পৌঁছে দেয়। শরীরের এই অবস্থা দেখে তার স্ত্রী আরেফিন আখতার পারভীন, পুত্র কে এম রহমান ও শিশু কন্যা আলফদাতুল মুনতাহা কান্নাকাটি শুরু করে। তাকে কোথায় চিকিৎসা করাবে; কিভাবে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে; পরিবারের লোকজন কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
তার স্ত্রী বলেন, ওই সময় দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এত আহত রোগীর ভীড়; মাত্র কয়েকজন চিকিৎসক কোনো রোগীকে ঠিকমতো চিকিৎসা দিতে পারছেন না। অনেক রোগী হাসপাতাল থেকে ফিরে বিভিন্ন ক্লিনিক বা স্থানীয় চিকিৎসকদের নিকট প্রাথমিক চিকিৎসা নেন। 
লেলিনের স্ত্রী আফরিন বাধ্য হয়ে শহরের হাউজিং মোড় এলাকায় হোমিও চিকিৎসক মো. আরিফুল ইসলামের নিকট নিয়ে যান। সেখানে লেলিন চিকিৎসা নেন। চিকিৎসক তাকে ওষুধপত্র দেন। 
হোমিও চিকিৎসক লেলিন ও তার স্ত্রীকে বলেন, শরীরের ভিতরে স্টিল বুলেট থাকলে ওষুধের প্রতিক্রিয়াই বের হয়ে যাবে। পরে তারা দু’জনই বাসায় ফিরে আসেন। বাসায় এসে জানতে পারেন পুলিশ তাকে খুঁজছে। আরেক দুশ্চিন্তায় পড়ে যান তারা। পরিবারের লোকজন তাকে তার বোনের বাসা শহরের নিমতলায় গোপনে রেখে আসেন। তার স্ত্রী ও বড় বোন সুশুমা রহমানের সেবা যত্নে এবং হোমিও চিকিৎসায় তার একমাত্র সুস্থ হওয়ার অবলম্বন ছিল তখন। শরীরের ব্যথায় কোনোভাবেই স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারছিলেন না। ব্যথায় অস্থিরতার মধ্যে তার দিন অতিবাহিত হয়। পর্যায়ক্রমে আঘাতের স্থানগুলোর মাংসে পচন ধরে যায়। 
তার বড় ভাই ঢাকার মিরপুরে ব্যবসায়ী খন্দকার শাহরুব মাহবুব লেলিনের শরীরের এই অবস্থার বিষয় জানতে পারেন। তিনি লেলিনকে দিনাজপুর থেকে অ্যাম্বুলেন্স যোগে গত ২৭ জুলাই বিকেলে ঢাকা মিরপুর ১- এ বারডেমের শাখা হাসপাতলে ভর্তি করেন। 
লেলিনের গুরুতর অবস্থা দেখে ওই হাসপাতালের চিকিৎসক দ্রুত তার শরীরে আঘাতের স্থানগুলো পচন ধরায় অস্ত্রোপচার করার সিদ্ধান্ত নেন। পরদিন ২৮ জুলাই তার শরীরে একাধিক স্থানে অস্ত্রোপচার করে ৬টি স্টিল বুলেট বের করেন। 
এরপর গত ২৭ জুলাই থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২০ দিন ওই হাসপাতালে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও প্রতিদিন একবার করে ডেসিং এর মাধ্যমে তার চিকিৎসা সেবা চলতে থাকে। এ সময়ের মধ্য তার আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় প্রায় ৬ লক্ষ টাকা চিকিৎসায় ব্যয় করতে হয়।
লেলিন ও তার স্ত্রী আফরিন বলেন, চিকিৎসার ব্যয় বহন করতে না পেরে; চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করে গত ১৫ সেপ্টেম্বর লেলিনকে ওই হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে তার বড় ভাই শাহারুবের বাসায় যান। ভাইয়ের বাসা থেকে প্রতিদিন হাসপাতালে গিয়ে লেলিনকে ড্রেসিং করা হয়। 
চিকিৎসক গত ২০ সেপ্টেম্বর পরামর্শ দেন তার আবারও অস্ত্রোপচার করতে হবে; এরজন্য অর্থ সংগ্রহ করতে বলেছেন জানান তারা। 
তার অপারেশন করতে প্রায় লক্ষাধিক টাকার প্রয়োজন। লেলিন, ঢাকা থেকে স্ত্রী ও পুত্র কে এম রহমানকে সঙ্গে নিয়ে রোববার সকালে দিনাজপুরে আসেন। পরে এসব বিষয়ে লেলিনের সঙ্গে কথা হয় বাসস প্রতিনিধির।
লেলিন জানান, তার চিকিৎসা করতে অনেক টাকার প্রয়োজন। নিজের থাকার পৈত্রিক বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই। 
তিনি ১৯৯৬ সালে এইচএসসি পাস করেছেন। কোনো চাকরি না পেয়ে পরিবহন শ্রমিকের পেশা বেছে নিয়ে ঢাকাগামী কোচে সুপারভাইজার হিসেবে চাকরি করতেন। হঠাৎ তার শরীরে ডায়াবেটিক আক্রান্ত হওয়ায়, কোচে সুপারভাইজারের ডিউটি করা তার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। ফলে তিনি রোজিনা এন্টারপ্রাইজ কোচের কাউন্টারে টিকিট বুকিং এর  কাজ করে।  এর মাধ্যমেই তার সংসার ভালোই চলছিল।
তার পুত্র কে এম রহমান এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। শহরের আলামিন উচ্চবিদ্যালয়ে পড়াশুনা করছে। লেলিনের অসুস্থ হওয়ার কারণে তার পুত্র ও স্ত্রী তাকে চিকিৎসা সেবা দিতে গিয়ে তার পুত্রের পড়াশুনা ঠিকমতো হচ্ছে না । ছোট শিশু কন্যা আলফিদাতুল মুনতাহা আলামিন স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়াশুনা করছে। 
লেলিনের আর্তনাদ তিনি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবেন কিনা? তার ঠিকমতো চিকিৎসা হবে কিনা? এসব বিষয় নিয়ে তিনি দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। তিনি এইভাবে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে পঙ্গু অবস্থায় থাকলে তার সংসার কিভাবে চলবে; দু'টি ছেলে-মেয়ের ভবিষ্যৎ লেখাপড়া কিভাবে হবে। এসব বিষয়ে কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছেন না তিনি। একই কথা বলছেন তার স্ত্রী আফরিন আখতার।
লেলিনের বড় বোন সুশুমা রহমান বলেন, আমরা চার ভাই ও এক বোন মিলে তার চিকিৎসার ব্যয় বহন করছি। এখন অল্প সময়ের মধ্যে তার শরীরে আরেকটি অপারেশন করা প্রয়োজন বলে চিকিৎসক বলেছেন। এ কারণে লেলিন অসুস্থতার মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এম্বুলেন্স যোগে ঢাকা থেকে দিনাজপুর এসেছে। নিকট আত্মীয় এবং  পরিচিত জনদের কাছ থেকে চিকিৎসার জন্য সহযোগিতা পাওয়ার আশায়। 
লেলিনের বড় ভাই ঢাকা মীরপুরে থাকেন, অপর তিন ভাইয়ের মধ্যে খন্দকার গাজীউল ওমর ও ইসমাইল ওমর দিনাজপুরে অটোবাইকের ব্যবসা করেন। সব ছোট ভাই মুশফিকুর সালেহীন মার্কেটাইল ব্যাংকে চাকরি করেন। তাদের বাবা খন্দকার মাহবুবুর রহমান ও মা রওশন মাহবুব মারা গেছেন। এখন তারা ৫ ভাই ও এক বোন রয়েছেন।  তারা সবাই একত্রিত হয়ে রোববার তার চিকিৎসার জন্য টাকা সংগ্রহ করেন। পরে ওইদিন রাতেই লেলিনকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠান। 
লেলিনের ভাই-বোন বলছেন, ‘বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার ঘোষণা দিয়েছেন; বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসা করাবেন। কিন্তু আমাদের ভাই লেলিন গুরুতর আহত হয়ে গত ৬৭ দিন ধরে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছেন। কেউ তার চিকিৎসা করতে সহযোগিতায় এগিয়ে আসেননি। এমনকি কেউ তার খোঁজ-খবরও নেওয়ার প্রয়োজন মনে করেনি। আমরা তার সু-চিকিৎসার  জন্য বর্তমান সরকারের নিকট সহযোগিতার দাবি জানাচ্ছি।’ 
তার স্ত্রী পুত্র-কন্যা ও লেলিন নিজে অসুস্থ অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তার সু-চিকিৎসার জন্য তারা সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি আহ্বান জানান।