বাসস
  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:২১

বুলেটের আঘাতে মুহূর্তেই মারুফের বিজয়ের আনন্দ পরিণত হলো বিষাদে

॥ রুপোকুর রহমান ॥
সাভার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪ (বাসস): ‘স্বৈরাচার সরকার পালিয়েছে, আমরা এখন স্বাধীন, আমাদের বিজয় হয়েছে। আমি বিজয় মিছিলে যাচ্ছি’ গত ৫ আগস্ট দুপুরে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর পেয়ে এমনই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী মিঠু ওরফে মারুফ। তার পরপরই বাসা থেকে বের হয়ে যান  বিজয় মিছিলে যোগ দিতে। বাড়ি ফেরেন লাশ হয়ে। একটি বুলেট মুহূর্তেই বিজয়ের আনন্দকে বিষাদে পরিণত করে দেয়। মারুফের পরিবারে এখন নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
সাভার টেকনিক্যাল অ্যান্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের বাণিজ্য বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মিঠু ওরফে মারুফ(১৯)। সাভার কলেজ রোডের বাসিন্দা শাহজাহান ইসলাম ও মালা আক্তারের পুত্র মিঠু দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট । মিঠুর বড় ভাই মীরজাহান মিলন শারীরিক অসুস্থতার কারণে বাড়িতেই থাকেন।       
মিঠুর বাবা শাহজাহান ইসলাম বাসসকে বলেন, ‘কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই রাজপথে সক্রিয় ছিল মারুফ। জুলাই মাসে সবগুলো আন্দোলনে বন্ধুদের সাথে যোগ দেয় সে। গত ৫ আগস্ট ‘রোড মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে বন্ধুদের সাথে ঢাকায় যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে সকালে বের হয়ে যায় মারুফ। বেলা ১১টার দিকে মারুফসহ তার বন্ধুরা যখন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের সাভার উলাইল বাসস্ট্যান্ড অতিক্রম করছিল তখন আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ আর পুলিশ মিলে তাদের গতিরোধ করে ধাওয়া দিয়ে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। একাধিকবার ঢাকার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়ে দুপুর ২টার দিকে বাড়ি ফিরে আসে। এর কিছুক্ষণ পরই জানা যায়, স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে, শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছে।’
শাহজাহান ইসলাম বলেন, শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরে উল্লসিত মারুফ বলতে থাকে, ‘আমরা এখন স্বাধীন, আমাদের বিজয় হয়েছে। আমি বিজয় মিছিলে যাচ্ছি’-আমাদের এ কথা বলেই বিকেলের দিকে আমাদের কলেজ রোডের বাসা থেকে বেরিয়ে যায়।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরই ঘাতকের বুলেট এসে লাগে মারুফের বুকে। গুলিবিদ্ধ মারুফ মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। এ অবস্থায় বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় পড়েছিলেন তিনি। পরে মারুফের সাথে থাকা বন্ধু ও পরিচিতজনরা ধরাধরি করে সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।  খবর পেয়ে হাসপাতালে যান মারুফের পরিবার।  
শাহজাহান ইসলাম বলেন, ‘ছোট ছেলেকে হারিয়ে বাসাটি শূন্য হয়ে গেছে। দুরন্তপনায় ঘর মাতিয়ে রাখা ছেলেটি আজ অধরা হয়ে গেছে। এ শোক কাটাবো কিভাবে। কিভাবে ভুলবো ছেলের স্মৃতি।’ এসময় তিনি মারুফ হত্যাকা-ের ঘটনায় দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ বিচার দাবি করে বলেন, ‘ছেলে হত্যার প্রকৃত বিচার পেলে কিছুটা হলেও শান্তি পাবো।’
পুত্রশোকে কাতর শাহজাহান ইসলাম বলেন, ছোট বেলা থেকেই আমার ছেলে মিঠু’র ছিল খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক। বড় হয়ে ভালো খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্ন ছিল তার।  খেলার প্রতি বেশী আগ্রহ থাকায় গ্রামের বাড়ী মাগুরায় গিয়ে মাগুরা জেলা ক্রীড়া সংস্থায় ভর্তি করানোর চেষ্টা করি। কিন্তু সেখানে সুযোগ না পেয়ে সাভার টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজে ভর্তি করি।
সাভার টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট কলেজের আইসিটি বিভাগের শিক্ষক নার্গিস আক্তার বাসস’কে বলেন, মারুফ অত্যন্ত বিনয়ী একজন শিক্ষার্থী ছিল। ছাত্র হিসেবেও ভালো ছিলো।  মারুফের মৃত্যুতে তিনি শোক প্রকাশ করেন ও তার পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানান।
মারুফের বন্ধু আঃ মান্নান বাসসকে বলেন, বন্ধু হিসেবে মারুফ ছিল অমায়িক। ওর মতো বন্ধু পেয়ে আমরা গর্বিত। ও যে কোন অন্যায় দেখলে প্রতিবাদ করতো। ৫ আগস্ট বিকেলে বিজয় মিছিলে আমিও ওর সঙ্গেই ছিলাম। মারুফসহ অন্যরা আমাদের থেকে একটু আগে অগ্রসর হওয়ায় আমরা পেছনে পড়ে যাই। এর কিছুক্ষণ পরই মারুফ বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। পরে আমি ও পরিচিত কয়েকজন হুইল চেয়ারে করে তাকে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মারুফের বড় ভাই মীরজাহান মিলন মারুফ হত্যাকা-ের সাথে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে বলেন, ‘দায়ীদের এমন শাস্তি দেওয়া হোক যাতে করে ঘাতকরা আর পরবর্তীকালে এমন দুঃসাহস দেখাতে না পারে। এমন হত্যাকান্ডে মেতে উঠতে না পারে।’
মারুফদের আত্মত্যাগের গৌরবগাথা যুগে যুগে লেখা হবে এমনই প্রত্যাশা তার পরিবার ও প্রতিবেশীদের।