বাসস
  ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৬:০৯
আপডেট : ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ১৮:৩১

ভিডিও কলে শহিদ বাবার সাথে কথা বলতে চান শিশু মুছহাব

 ॥ এ.এস.এম.নাসিম ॥

নোয়াখালী, ৪ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস): সাড়ে তিন বছরের শিশু মুছহাব। সারাদিন বাবা, বাবা ডাকে মাতিয়ে রাখেন পুরো বাড়ি। বাবা কখন আসবে তা জানতে চায় মা সুলতানা আক্তারের কাছে। বায়না ধরে বাবার সাথে ভিডিও কলে কথা বলার। ভিডিও কলে বাবাকে না পেয়ে শুরু করে কান্নাকাটি। কিন্তু বাবা যে আর কখনো আসবে না তা বুঝার এখনো বয়স হয়নি শিশু মুছহাবের । ‘বাবা আর কখনো আসবে না’ মায়ের কাছে এমন কথা শুনলেই সে মাথা নেড়ে বলে,‘বাবা আসবে’।

মুছহাবের বাবা মামুন হোসেন(৩০) বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলা কালে ১৯ জুলাই (শুক্রবার) বিকেলে রাজধানী ঢাকার মহাখালী ফ্লাইওভার এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন। 

তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালি সদর উপজেলার বিনোদপুর ইউনিয়নের জালিয়াল গ্রামে। গত ২০ জুলাই বিকেলে গ্রামের বাড়িতে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে মামুনের লাশ দাফন করা হয়। পরিবারের উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে অনেকটাই নির্বাক তার বাবা-মা। স্বামীর শোকে পাথর বনে গেছেন স্ত্রী সুলতানা আক্তার। মামুনের সাড়ে তিন বছরের ছেলে মো. মুছাব হাসান এখনো জানে না তার বাবা আর কখনো ফিরবে না।

জালিয়াল গ্রামের হাবিব উল্যাহ ব্যাপারীর বাড়িতে গিয়ে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার এই প্রতিবেদকের সাথে কথা হয় নিহত মামুনের বাবা-মা, স্ত্রীসহ প্রতিবেশীদের সাথে। মামুনের বাবা আবদুল মতিন জানান, সেদিন ১৯ জুলাই বিকেলে আসরের নামাজ পড়ে মহাখালী ফ্লাইওভারের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন তার ছেলে মামুন। হঠাৎ একটি গুলি মামুনের পেটের ডান পাশে ঢুকে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই সড়কে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তখন ওই এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ চলছিল।

মামুনকে লুটিয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে আসেন আশপাশের পথচারীরা। তারা তাকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান।

আবদুল মতিন(৫০) বলেন, খবর শুনে তিনি ছুটে যান ওই হাসপাতালে। সেখান থেকে ছেলেকে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার পরিস্থিতি তখন এতটাই খারাপ, চিকিৎসা করানোর মতো কোনো অবস্থা ছিল না। পরে ছেলেকে নিয়ে যান মহাখালীর একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। কিন্তু সেখানেও মেলেনি প্রয়োজনীয় চিকিৎসা। অনেক চেষ্টা করেও কোনো চিকিৎসককে হাসপাতালে আনতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। পরে বিনা চিকিৎসায় শুক্রবার রাত তিনটায় ওই হাসপাতালে মারা যান তার ছেলে।

সেখান থেকে পরদিন বিকেলে লাশ গ্রামের বাড়িতে এনে দাফন করেন। ভয়ে প্রশাসনের কাউকে জানায়নি তারা। ময়নাতদন্ত ছাড়াই গুলিবিদ্ধ বুলেটসহ দাফন করা হয় মামুনের মরদেহ।

আবদুল মতিন বলেন, তিনি পেশায় গাড়িচালক। ঢাকায় এক চিকিৎসকের গাড়ি চালান তিনি। তার চার ছেলে। তাদের মধ্যে তিনজনই তার দেখাদেখি গাড়ি চালক হয়েছেন।

দীর্ঘদিন গাড়ি চালিয়ে সন্তানদের বড় করেছেন। তারা কাজ শুরু করেছেন অন্যের গাড়ি চালিয়ে। এরই মধ্যে মনে হলো, নিজেদের যদি একটি গাড়ি থাকত, তাহলে ছেলেরা চালিয়ে রোজগার করতে পারতেন। এরই মধ্যে তার মালিক (অবসরপ্রাপ্ত চিকিৎসক সেনা কর্মকর্তা) নিজের একটি প্রাইভেট কার বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ধারদেনা করে চলতি মাসের শুরুতে ওই গাড়ি কিনে মেজ ছেলে মামুনকে চালাতে দেন। ছেলে গাড়ি পেয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু একটি গুলি তার সেই স্বপ্ন শেষ করে দিলো।

মামুনের স্ত্রী সুলতানা আক্তার(১৮) জানান, শেষবার যখন কথা হয়, তখন তার স্বামী বলেছিলেন, ঢাকায় অনেক গন্ডগোল হচ্ছে। তাই তিন দিন ধরে বাইরে বের হতে পারছেন না।

পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তিন-চার দিন পর বাড়িতে আসবেন। কিন্তু তার সেই আসা আর হলো না। এর আগে স্বামীর লাশ দেখতে হয়েছে তাকে। এখন একমাত্র অবুঝ ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাঁর যত চিন্তা। বাবা মারা গেছেন, এটুকু বোঝার বয়সও হয়নি তার।

মামুনের মা ফাতেমা খাতুন(৪৫) জানান, বাড়িতে ঘরের ভিটা ছাড়া তাঁদের কোনো জায়গা নেই। চার ছেলের তিনজনকে বিয়ে করিয়েছেন। ছোট্ট একটি টিনের ঘরে অনেক কষ্ট করে ছেলে, ছেলের বউ, নাতিদের নিয়ে থাকতে হয়। আশা ছিল, ছেলে গাড়ি চালিয়ে বাড়তি রোজগার করবেন। পরিবারের হাল ধরবেন। কিন্তু সব আশা শেষ হয়ে গেছে। ছোট্ট নাতির দিকে তাকালে বুকটা ফেটে যায়। সে এখন কাকে বাবা বলে ডাকবে?

এ প্রশ্ন মামুনের স্ত্রীরও। কারণ শিশু মুছহাবকে সামলাতে তার অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। বাবা নেই মুছহাব তা বুঝতেই পারছে না।

এদিকে পরিবারটির কাছে এখনও তেমন কোন সাহায্য সহযোগিতা পৌঁছেনি। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক খন্দকার ইশতিয়াক আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, শহিদ মামুনের পরিবারের সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। আমরা সরকারিভাবে কোন বরাদ্দ পেলে অবশ্যই তাদের কাছে পৌঁছে দেবো।