শিরোনাম
॥ মোঃ মামুন ইসলাম ॥
রংপুর, ৫ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মাত্র সাড়ে তিন মাস আগেও মমদেল হোসেন একজন পরিশ্রমী এবং উদ্যমী যুবক ছিলেন। কিন্তু বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনকালে বুলেটবিদ্ধ হয়ে তিনি এখন বিপর্যস্ত। কারণ বাম পা হারিয়ে মমদেল পঙ্গু এবং অসহায়।
মমদেল(২৯) পেশায় একজন ওয়েল্ডিং শ্রমিক। তিনি রংপুর মহানগরীর আলমনগর খামার চুড়িপট্টি বস্তির রেল লাইনের ধারঘেঁষা একটি ছোট্ট ঘরে তার ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী জমিলা বেগম (২৪) এবং একমাত্র ছেলে জাহিদ হাসানকে (৭) নিয়ে থাকেন।
একমাত্র পুত্র ও অনাগত সন্তানকে ঘিরে ছিল তার ছোট ছোট স্বপ্ন। সন্তানদের শিক্ষিত করবেন, তাদের যোগ্য নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলবেন।
কিন্তু বিধি বাম। স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামল কেড়ে নিল তার একটি অঙ্গ। অঙ্গ হারিয়ে মমদেল নিয়তির নির্মম পরিহাসের শিকার এখন।
গত ১৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একটি অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ সমাবেশে ফ্যাসিবাদী শাসকের পুলিশের গুলিতে আহত হন মমদেল। ডাক্তাররা তার জীবন বাঁচাতে একটি পা কেটে ফেলেন। সারাজীবনের জন্যে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হলো মমদেলকে। আর তার পরিবারের ভাগ্যে নেমে এসেছে এক ভয়াবহ অন্ধকার।
সম্প্রতি তাদের বস্তিতে বাসস’র এ প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার সময় মমদেল ও তার স্ত্রী জামিলা বেগম তাদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এ সময় বস্তিবাসী নারী-পুরুষ জড়ো হয়ে যায়। সে সময়ে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও অন্যান্য গণ্যমান্য ব্যক্তিবগর্ও উপস্থিত ছিলেন।
মমদেল বলেন, দীর্ঘদিন যাবৎ তার বয়োবৃদ্ধ পিতা কবির হোসেন (৭০) জটিল হাঁপানি রোগে আক্রান্ত। তিনি চলাফেরা ও কাজকর্ম করতে পারেন না। মমদেলের মা মনোয়ারা বেগম (৫৫) তার হতদরিদ্র বাবার সাথে শহরের অদূরে ভুড়ারহাট গ্রামে বসবাস করেন। মনোয়ারা বেগম বিভিন্ন স’মিল ও কাঠের দোকান থেকে কাঠখড়ি এনে বিক্রি করে সামান্য কিছু আয় করেন। তা দিয়ে অসুস্থ স্বামীর সাথে জীবন যাপন করেন।
চার ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থ মমদেল। তার বড় বোন গৃহবধূ কোহিনূর বেগমের (৩৮) স্বামী হতদরিদ্র সাজু মিয়া একজন শ্রমজীবী। এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে তারা অভাব-অনটনের মধ্যে একই বস্তিতে বাস করেন। মমদেলের মেজ বোন লাবনী বেগমের (৩৫) দিনমজুর স্বামী এরশাদ মিয়াও দুই পুত্র সন্তানকে নিয়ে মহানগরীর বাস টার্মিনাল এলাকায় বসবাস করেন। আর মমদেলের বড় ভাই দিনমজুর শের আলী মধু (৩২) তার স্ত্রী, এক পুত্র ও এক কন্যা সন্তানকে নিয়ে বস্তিতে বাস করেন।
মমদেল ২০১৬ সালে কুড়িগ্রাাম জেলার নাগেশ্বরী উপজেলার পাটেশ্বরী গ্রামের জামিলা বেগমকে বিয়ে করেন। স্ত্রীকে নিয়ে তিনি আলমনগর খামার চুড়িপট্টি বস্তিতে বাস করছেন। এর মাঝে তাদের পুত্র সন্তান জাহিদ হাসানের জন্ম হয়। ওয়েল্ডিং মিস্ত্রি হিসেবে কাজ করে মমদেল মাসে সাড়ে সতরো হাজার টাকা বেতন পেতেন। তা দিয়েই চলছিল তাদের সংসার। বর্তমানে তার স্ত্রী জামিলা ছয় মাসের গর্ভবতী। পুত্র জাহিদ হাসান তাদের বস্তি থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে গ্রামীণ উন্নয়ন কেন্দ্র (গাক) নামের একটি এনজিও পরিচালিত শিশু বিকাশ কেন্দ্রে প্রথম শ্রেনীতে পড়াশুনা করে।
মমদেল বলেন, ‘পৈতৃক নিবাস এই খামার চুড়িপট্টিতেই আমার জন্ম। আমার পিতা-মাতার কোনো অক্ষরজ্ঞান নেই। আমিও কোনোদিন স্কুলে যাইনি। লেখাপড়া জানি না। আমার কোনো উচ্চাকাক্সক্ষা ছিল না।’
তিনি বলেন, ‘আমি শিশুকালেই ওয়েল্ডিং ওয়ার্কশপে শ্রমিক হিসেবে কাজ শুরু করি। গত ১৯ জুলাই বাম হাঁটুতে পুলিশের গুলি লাগে। এর আগে পর্যন্ত আমি ২০ বছর যাবত স্থানীয় লালবাগ বাজারের চৌকিহাটে অবস্থিত নূর মেটাল ওয়ার্কশপে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। মাসে সাড়ে সতর হাজার টাকা বেতন ছিল। গুলি লাগার পর থেকে কাজও বন্ধ, বেতনও বন্ধ।’
জুলাই মাসের ঐ সময়টা বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার দুর্বার আন্দোলনে উত্তাল ছিল রংপুর। গত ১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে শহিদ হবার পর রংপুরসহ দেশব্যাপী ছাত্র-জনতার আন্দোলন অগ্নিগর্ভ রূপ নেয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত এক দফার দাবিতে পরিণত হয়। আর আরো উত্তাল হয়ে ওঠে রংপুর। নগরীজুড়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের আক্রমণ, গুলি বর্ষণ, বর্বরতা ও নির্যাতন সকল মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।
মমদেল বলেন, ‘ওইদিন ১৯ জুলাই শুক্রবার ছিল। সকাল নয় টায় ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে বরাবরের মত সকালের নাস্তা হিসেবে ভাত খাই। এরপর হেঁটে হেঁটে এক কিলোমিটার দূরের আমার কর্মস্থল লালবাগ বাজারের চৌকিহাটি এলাকায় নূর মেটাল ওয়ার্কশপে যাই। ওয়ার্কশপ বন্ধ ছিল। আমার স্ত্রী-পুত্র তখন আমার বাবার বাড়ী ভুড়ারহাট গ্রামে ছিল। আমি তখন ওয়ার্কশপ থেকে ভুড়ারহাট গ্রামে যাই। আমার রংপুরের বস্তিতে পানির ব্যবস্থা না থাকায় আমি আমার বাবার বাড়িতে গোসল করি। সেখানে মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায় করার পর খাওয়া-দাওয়া শেষে স্ত্রী-পুত্রকে সাথে নিয়ে রংপুরের বস্তিতে ফিরে আাসি।’
মমদেল বলেন, ‘সংসারে অভাবের কারণে আমি সবসময় কাজ করার চেষ্টা করতাম। ঐ সময় রংপুর স্টেডিয়ামে আগে থেকেই আমাদের ওয়ার্কশপের ওয়েল্ডিং কাজ চলছিল। ঐদিন ওয়ার্কশপ বন্ধ থাকায় আমি কিছু কাজের আশায় রংপুর স্টেডিয়ামে যাবার জন্য বিকেল তিনটার দিকে বস্তি থেকে রওনা হই।’
ঐখানে গিয়ে দেখি স্টেডিয়ামেও কাজ বন্ধ ছিল। ফলে, আবার বাড়ি ফেরার জন্য পায়ে হেঁটে রওনা দেই। সন্ধ্যা সোয়া ছয়টার দিকে আমি রংপুর সিটি বাজারের নিকট রাজা রামমোহন ক্লাব মার্কেটের সামনে পৌঁছাই।
তখন সেখানে নগরীর প্রধান সড়কে সর্বত্রই বিপুল সংখ্যক মারমুখী পুলিশ ও অন্যান্য আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যকে বিক্ষোভকারী হাজার হাজার ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ওপর ভয়ানক হামলা, লাঠিচার্জ, টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ এবং গুলি বর্ষণ করতে দেখি। সেখানে এক শ্বাসরুদ্ধকর ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। প্রাণে বাঁচার জন্য লোকজন দিকবিদিক ছুটতে থাকে।
মমদেল বলেন, ‘এসময় আমি ফুটপাথের উপর দাঁড়িয়ে ছিলাম। মিছিলকারীদের ওপর পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করছিল। আমি সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য রাজা রামমোহন ক্লাবের বাম পাশের গলি দিয়ে বাজারে ঢোকার চেষ্টা করলাম। এ সময় আমার কাছ থেকে মাত্র ১০/১৫ ফুট দূরে একজন যুবকের বুকে গুলি লেগে সে মাটিয়ে লুটিয়ে পড়ে। এ সময় আমারও বাম হাঁটু এবং বাম হাতে গুলি লাগে। গুলিটি বাম হাঁটু ও বাম হাত ভেদ করে বের হয়ে যায়। তখন আমি প্রাণ বাঁচাতে কোনরকমে ফল বিক্রির গলির মাথা পর্যন্ত আহত অবস্থায় এগিয়ে যাই। এরপর অজ্ঞান হয়ে পড়ি। তারপর আর আমি কিছু জানি না। পরে শুনেছি,উপস্থিত জনগণ আমাকে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। রাতে জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি হাসপাতালের তিনতলায় ৩১ নম্বর অর্থোপেডিক্স সার্জারি ওয়ার্ডের একটি বেডে চিকিৎসাধীন।
মমদেলের স্ত্রী জামিলা জানান, মেডিকেল থেকে তখন রাত ৮ টার দিকে আমার স্বামীর মোবাইল ফোন থেকে কেউ একজন আমাকে কল দিয়ে খবর দেন। সাথে সাথে আমি হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি ডাক্তাররা আমার স্বামীর পায়ে ব্যান্ডেজ করছিলেন। আমার স্বামী তখনও অজ্ঞান ছিল। রাত ৯টার দিকে ব্যান্ডেজ করা শেষ হলে আমার স্বামীর জ্ঞান ফেরে। এ সময় লোকজন আমার স্বামীর জন্য রক্ত দিয়েছেন। আমাকেও কিছু রক্ত কিনতে হয়। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মোট তিন ব্যাগ রক্ত লেগেছে।
পরদিন ২০ জুলাই সন্ধ্যায় ডাক্তার আমার স্বামীকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। ডাক্তার ধারণা করেন যে গুলি লেগে আমার স্বামীর হাঁটুতে থাকা রগগুলো ছিঁড়ে গেছে। আমরা খুব গরীব মানুষ। টাকা পয়সার বড় অভাব। তারপরেও টাকা পয়সা ধার করে ১৫ হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করি। আমার স্বামীকে নিয়ে ঢাকার পথে রাত দশটার দিকে রওনা দেই। পরদিন সকাল আটটার দিকে ঢাকা পঙ্গু হাসপাতাল পৌঁছি। আমার স্বামীকে পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি করাই। তখন ডাক্তার রড দিয়ে খাঁচার মত বানানো নেট দিয়ে গুলি লাগা হাঁটুর অংশ ঢেকে দেন। এরপরে ডাক্তার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে হাঁটুর মাংস সবল আছে কিনা তা পরীক্ষা করার জন্য আমার স্বামীকে সেখানে নিয়ে যেতে বলেন।
জামিলা বলেন, ‘ঐদিন ২১ জুলাই বিকাল চারটায় পঙ্গু হাসপাতাল থেকে নিজের টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আমার স্বামীকে নিয়ে হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে যাই। সেখানে আমরা তাকে ভর্তি করাই। সন্ধ্যার আগে ডাক্তার ওষুধ লিখে দিয়ে বলেন যে এগুলো দ্রুত নিয়ে আসেন। ওই ওষুধ আনার পরে মাংস পরীক্ষা করা হবে। এ সময় ওষুধ নিতে আমার সাথে যাওয়া আমার স্বামীর দুই মামা খোকন এবং নাজমুলসহ আমি গেইট থেকে বের হয়ে রাস্তায় উঠি। সাথে সাথে সেখানে থাকা পুলিশ আমাদেরকে জিজ্ঞাসা করে কিসের রোগী, কোথা থেকে নিয়ে এসেছেন ইত্যাদি। আমি মিথ্যা কথা বলি যে আমার স্বামী সিএনজি অ্যাক্সিডেন্টের রোগী।
তখন পুলিশ জোর করে কাগজগুলো হাতে নিয়ে বলে এই রোগী তো গুলিবিদ্ধ। আমাদেরকে আটকে দেয়। ওষুধ কেনার জন্য আর যেতে পারলাম না। এ সময় পুলিশের আগ্রাসী ভাব দেখে ভয়ে আমাদের দুই মামা সেখান থেকে পালিয়ে যান। কোনো উপায় না দেখে আমি ঔষধ ছাড়াই আবার জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে ফিরে আসি। ডাক্তারকে বিষয়টা জানালাম। তিনি বললেন এসব ওষুধ ছাড়া চিকিৎসা করা সম্ভব নয়।
মমদেল বলেন, ‘তখন আমি আমার স্ত্রীকে বলি, আমি তো মরেই গেছি। যা হয় হোক, তুমি একাই গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসো। আমি তো মরেই গেছি। তুমি ওষুধ আনতে গিয়ে যদি পুলিশ তোমাকেও মেরে ফেলে তাহলে মরেই যেও। তখন আমার গর্ভবতী স্ত্রী একাই ওষুধ আনতে বের হয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর সে ওষুধ নিয়ে ফিরে আসে। ডাক্তারকে ওষুধ দিলে আমার চিকিৎসা শুরু হয়। এক ঘণ্টার মধ্যেই হাতে মাংস পরীক্ষার রিপোর্ট পাই। রিপোর্ট পাবার আগে নাজমুল মামা বাইরে থেকে ফোন করে আমাদেরকে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে বলে। কারণ, তখনো স্বৈরাচার হাসিনার আমল ছিল। পুলিশ যা খুশি তাই করতে পারে।
মমদেল বলেন, জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটে রিপোর্ট পাওয়ার পর তা নিয়ে পঙ্গু হাসপাতালে স্ত্রীর সাথে ফিরে আসি। কিন্তু সেখানে আর ভর্তি হওয়া সম্ভব হয়নি। কাগজ গুলো ডাক্তারের কাছে আমার স্ত্রী নিয়ে যায়। তখন রিপোর্টের কাগজ দেখে ডাক্তার বলেন মাংসে পচন ধরেছে, গ্যাংগ্রিন হয়েছে। পা টিকবে না। এটা কেটে ফেলতে হবে। একথা আমার স্ত্রী আমাকে জানায়। এ সময় ভাবলাম আমার স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। সে নিজেই অসুস্থ। পঙ্গু হাসপাতালে যদি পা কাটি, তাহলে সেখানে সে আমার দেখাশুনা করতে পারবে না। অন্যদিকে পুলিশ হন্যে হয়ে আমাকে খুঁজতেছিল। উপায়ান্তর না দেখে পুনরায় রংপুরে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিই।
জামিলা বলেন, আবারো ১৫ হাজার ছয়শ’ টাকায় একটা অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করি। আমার স্বামীকে নিয়ে রংপুর রওনা দেই। আমরা সেখান থেকে পালিয়ে আসায় টেস্ট রিপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র পঙ্গু হাসপাতালের ডাক্তারের কাছে থেকে যায়। আমরা সাথে আনতে পারিনি। পরদিন ২২ জুলাই ফজরের আযানের সময় আমরা রংপুর পৌঁছাই। এরপর রংপুর হেলথ সিটি হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পাশে অবস্থিত ডক্টরস কমিউনিটি হাসপাতালে আমার স্বামীকে ভর্তি করাই। এখানেও ভর্তির সময় মিথ্যা কথা বলি যে আমার স্বামী সিএনজি এক্সিডেন্টের রোগী। কারণ গুলি লাগার কথা শুনলে পুলিশি ঝামেলার ভয়ে ভর্তি করবে না।
এই হাসপাতালে ডাক্তারেরা পায়ের মাংস ঠিক করার জন্য তিন দিন আমার স্বামীর চিকিৎসা করেন। এতে করেও পায়ের মাংস বা মাংসপেশিতে কোন অনুভূতি সৃষ্টি না হওয়ায় ডাক্তার পা কেটে ফেলতে বলেন। কারণ মাংসপেশীতে ও মাংসে পচন ধরে গ্যাংগ্রিন হয়েছিল।
মমদেল জানান, পা কেটে ফেলার বিষয়টি তখন আমি আমার মা-বাবাকে জানাই। আমার বেঁচে থাকার স্বার্থে তারাও সম্মতি দেন। পরে ২৫ জুলাই সেখানে আমার বাম হাঁটুতে সার্জারি করে হাঁটুর খানিকটা উপর থেকে নিচের সমস্ত অংশ কেটে ফেলা হয়। এভাবে আমি পঙ্গু হয়ে যাই। জীবনে কখনো ভাবিনি আমাকে পঙ্গুত্ব বরণ করতে হবে।
মমদেল বলেন, ‘জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর)-এর অর্থোপেডিক সার্জন ডাক্তার মো: আব্দুল হালিম রংপুরে ডক্টরস কমিউনিটি হাসপাতালে আমার পায়ে সার্জারি করেন। এরপর হাসপাতালে সাত দিন রাখার পরে আমাকে রিলিজ দেওয়া হয়। এই হাসপাতালে সব মিলে আমার প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ হয়। এ পর্যন্ত আমার চিকিৎসার জন্য মোট তিন লাখ টাকার উপরে খরচ হয়েছে।’
মমদেল বলেন, ‘আমার চিকিৎসার জন্য আমার স্ত্রী আমার হতদরিদ্র বাবার কাছ থেকে দেড় লাখ টাকা, আমার ভাই-বোনদের কাছ থেকে এক লাখ টাকা এবং বাংলা জার্মান সম্প্রীতি থেকে আমার নেওয়া লোনের ৫০ হাজার টাকা একত্র করে। এছাড়াও আমাদের হতদরিদ্র স্বজনদের কাছ থেকে আরো ৫০ হাজার টাকা ধার করতে হয়। বর্তমানে আমার কাঁধে মোট ঋণের পরিমাণ তিন লাখেরও বেশি। আহত হবার পর থেকে প্রতিমাসে বাংলা জার্মান সম্প্রীতিকে কিস্তির ১,৩৫০ টাকা আর দিতে পারিনি।
সংসারে আমিই একমাত্র উপার্জনক্ষম ছিলাম। আহত হবার পর উপার্জন বন্ধ হওয়ায় চাল-ডাল কেনাও বন্ধ হয়ে যায়। ফলে ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বলতে গেলে আমার বাসার চুলাই জ¦ালানো হয়নি। আমার আত্মীয়-স্বজন সবাই হতদরিদ্র এবং বস্তিবাসী হওয়া সত্ত্বেও তারা তখন থেকে মাঝে মাঝে আমাদেরকে কিছু ভাত তরকারি দিয়ে গেছেন। আমরা সেইগুলোই আমাদের একমাত্র সন্তানকে সাথে নিয়ে খাই।
এরপর ১০ আগস্ট রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পুনরায় ভর্তি হই। কারণ তখন আবার আমার বাম হাতের গুলি লাগা মধ্য আঙুলে গ্যাংগ্রিন দেখা দেয়।
মমদেল বলেন, আমি আহত হওয়ার পর পর রংপুর মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহবায়ক মোঃ শহিদুল ইসলাম মিজু সর্বপ্রথম আমাকে বিশ হাজার টাকা দান করেন। এই টাকা আমার চিকিৎসায় ব্যয় করি। পরবর্তী সময়ে মহানগর বিএনপির সদস্যসচিব অ্যাডভোকেট মাহফুজ উল নবী ডন আমাকে দশ হাজার টাকা দেন এবং আরো কয়েকজন এক থেকে পাঁচ হাজার করে মোট ২০ হাজার টাকা সাহায্য দেন।
মমদেল বলেন, ‘সর্বশেষ বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক ময়নুল ইসলাম গত ২৬ অক্টোবর রংপুরের একটি অনুষ্ঠানে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহিদ ও আহতদের সাথে আমাকেও ২৫ হাজার টাকা প্রদান করেন।’
তিনি বলেন, বর্তমানে আমি পঙ্গু। আমার স্ত্রী ছয় মাসের গর্ভবতী। বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি আমার আকুল আবেদন দেশে বা বিদেশে, যেখানে সম্ভব আমার শরীরে কৃত্রিম পা সংযোজন করে আমাকে আবারো কর্মক্ষম করে তুলুন। আমাকে পর্যাপ্ত সরকারি সাহায্য দিন। আমাকে ঋণ মুক্ত করুন। নতুন করে স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশে আমি যেন একজন স্বাধীন মানুষ হিসেবে কাজকর্ম করে পরিবারসহ সম্মানের সাথে জীবনযাপন করতে পারি, সে সুযোগ আমাকে দিন।
জামিলা বেগম অর্ন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সকল শহিদ এবং আহতদের পরিবারের পুনর্বাসন ও চিকিৎসা কার্যক্রমের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন করার আবেদন জানান।
গত ২৫ জুলাই রংপুরের ডক্টরস কমিউনিটি হাসপাতালে মমদেলের হাঁটুতে অস্ত্রোপচার করেছিলেন নিটোর বিশেষজ্ঞ অর্থোপেডিক সার্জন ডাঃ মোঃ আব্দুল হালিম। তিনি বাসসের সাথে আলাপকালে বলেন, নিটোরেও মমদেলের শরীরে কৃত্রিম পা সংযোজন করা সম্ভব।
তবে এ জন্যে দরকার অর্থ। হতদরিদ্র পরিবারটি এ অর্থ এখন কোথায় পাবে? কার কাছে যাবে তারা?