শিরোনাম
॥ এসকে রাসেল ॥
কিশোরগঞ্জ, ৬ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ছোট ছোট তিনটি সন্তান শহিদ আব্দুল কুদ্দুসের। আবারো সন্তান জন্ম দেয়ার অপেক্ষায় তার স্ত্রী ফারজানা আক্তার। এদিকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশ নিয়ে শহিদ হয়েছেন স্বামী। এখন কি করবেন ফারজানা? ছোট তিন সন্তানসহ পরিবারের অনাগত সদস্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় দিন কাটছে তার।
এছাড়া শহিদ আব্দুল কুদ্দুসের তিন বছর বয়সী উদয় প্রতিরাতে অপেক্ষায় থাকে বাবা কখন ফিরবে মজা নিয়ে। অনাগত সন্তান পৃথিবীতে এসে দেখতেই পাবে না বাবার মুখ। এদিকে শহিদ আব্দুল কুদ্দুসের মা-বাবাও ছেলের শোকে একেবারে কাতর।
বলছিলাম কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার দিঘীরপাড় ইউনিয়নের শাহপুর চেঙ্গাহাটি গ্রামের তিন সন্তানের জনক কৃষক শহিদ আব্দুল কুদ্দুসের (৩৫) কথা।
শহিদ আব্দুল কুদ্দুসের বৃদ্ধ বাবা জামাল মিয়া (৭৫) ও মা রাবেয়া খাতুন (৬০)।
বড় ভাই মো. বিল্লাল মিয়া (৪৫) বাড়ির পাশে মুদির দোকান দিয়ে সংসার চালান। ছোট বোন লিপা আক্তার (২৮)কে বিয়ে দিয়েছেন। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে দ্বিতীয় ছিলেন শহিদ আব্দুল কুদ্দুস।
আব্দুল কুদ্দুস শহিদ হওয়ার কিছুদিন পরে উপজেলার বলিয়ারদী ইউনিয়নের শিমুলতলায় তিন সন্তান নয়ন মিয়া (১২), মনি আক্তার (৯) ও উদয় (৩) কে নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে যান সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ফারজানা আক্তার (৩০)। সেখানেই বৃদ্ধ বাবা আসাদ মিয়া (৮২), মা সাজেদা বেগম (৭০) ও বড় ভাই আহাদু মিয়ার (৩২) সাথে বসবাস করছেন।
জানা গেছে, গত ৪ আগস্ট প্রথমে কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর উপজেলার সরারচর বাজারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন বিএনপি সমর্থক শহিদ আব্দুল কুদ্দুস। পরে সেখান থেকে বাজিতপুর উপজেলা সদরের মোরগমহল এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন। সেখানে আব্দুল কুদ্দুস আহত হলে তাকে ধরে নিয়ে যায় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের লোকজন। তাকে মারধর করে ও অত্যাচার চালিয়ে ফেলে রেখে যায়। পরে সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলে চিকিৎসক শহিদ আব্দুল কুদ্দুসকে মৃত ঘোষণা করেন। পুলিশের কাছ থেকে লাশ পেতে পরিবারকে অনেক বেগ পেতে হয়। শেষ পর্যন্ত ময়নাতদন্ত ছাড়াই এলাকার গোরস্থানে দাফন করা হয় শহিদ আব্দুল কুদ্দুসকে।
ফারজানা আক্তার বাসসকে বলেন, ‘তিনটি ছোট্ট ছোট্ট শিশু সন্তান নিয়ে খুবই কষ্টে দিন যাচ্ছে আমাদের। ছোট্ট শিশু উদয় এখনও প্রতি রাতেই অপেক্ষায় থাকে তার বাবা তার জন্য মজা(স্থানীয় খাবার) নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। কি করে বোঝাবো তাকে যে, তার বাবা আর আসবে না, কোনো দিনই আসবে না। আরেক সন্তান পেটে রয়েছে সে পৃথিবীতে এসে বাবাকেও ডাকতে পারবে না। তার বাবার মুখও দেখতে পারবে না। কৃষি কাজ করেই সংসার চালাতেন আমার স্বামী। এখন চলার মতো আমার কাছে কোনো সম্বল নেই। আমি সরকারের কাছে দাবি জানাই আমার স্বামী আব্দুল কুদ্দুসকে যেনো রাষ্ট্রীয়ভাবে যথাযথ শহীদি মর্যাদা দেওয়া হয়।’
ফারজানা আরো বলেন, ‘তিন সন্তান ও অনাগত এক সন্তান তাদেরকেও যেনো ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকার নেয়। আমি বিধবা হয়েছি। আমার তিন সন্তান এতিম হয়েছে। অনাগত সন্তানও পিতৃহীন হয়েছে। যারা আমার স্বামীকে হত্যা করেছে আমার সন্তানদের এতিম করেছে আমি তাদের ফাঁসির দাবি জানাই।’
বড় সন্তান নয়ন মিয়া (১২) বলেন, বাবা আমাদের অনেক আদর করতেন। প্রতিরাতেই বাবা বাজার থেকে মজা নিয়ে আসতেন। আমার বাবা আর কোনো দিন আসবে না। এই বলে নয়ন কান্না জুড়ে দেয়।
বড় ভাই মো. বিল্লাল মিয়া (৪৫) জানান, কিশোরগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের শহিদদের তালিকায় আট নম্বরে আমার ভাই শহিদ আব্দুল কুদ্দুসের নাম রয়েছে। আমার ভাই দেশের জন্য শহিদ হয়েছে। আমার বৃদ্ধ মা-বাবা রয়েছে। তার তিনটি সন্তান ও সন্তানসম্ভবা স্ত্রী রয়েছে। তাদের দায়িত্ব সরকারকেই নিতে হবে। না হলে এরা যাবে কোথায়?
তিনি জানান, ইতোমধ্যে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকার অনুদান পেয়েছি।
তিনি তার ভাই হত্যার সঠিক বিচার চান।
বাবা জামাল মিয়া বলেন, সরকার যদি এখন আমাদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে পথে বসা ছাড়া আমাদের আর কোন উপায় থাকবে না। এখন কে আমাদের কাজ করে খাওয়াবে? কুদ্দুসওতো মারা গেছে। আর আমাদের দাবি সরকার যাতে আমাদের দায়িত্ব¡ নেয় এবং আমার ছেলে কুদ্দুসকে যারা হত্যা করেছে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়।
মা রাবেয়া খাতুন জানান, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই জানে আমার ছেলে কেমন ভালো মানুষ ছিল। সবার আগে সে সকলকে সালাম দিতো। আমার কুদ্দুস বাবা আর ফিরবে না, এ কথা মানতে আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছে।
কিশোরগঞ্জ জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক মো. রমজান আলী জানান, বাংলাদেশের জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে প্রত্যেক শহিদ পরিবারকে দুই লাখ টাকার অনুদান দেয়া রয়েছে। দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করা এসব শহিদ পরিবার যদি কোন সমস্যায় পড়ে তাহলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী তাদের পাশে দাঁড়বে।