শিরোনাম
॥ সাজ্জাদ হোসেন ॥
ঢাকা, ৭ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার পতনে সারাদেশ আনন্দে মুখরিত হয়ে ওঠে। লাখ লাখ মানুষ নেমে আসে রাস্তায়। যোগ দেয় বিজয় মিছিলে। আমার বাবাও কষ্টকর আন্দোলন সংগ্রামে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু যেদিন বিজয় এলো তিনি আর তা উদযাপন করতে পারেননি। আমাদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন পরপারে।
অশ্রুসিক্ত চোখে কথাগুলো বলছিলেন শহিদ ইসহাকের বড় ছেলে মো. সবুজ জমাদ্দার।
তিনি বলেন, সবাই যখন বিজয়ের আনন্দে মাতোয়ারা তখন আমাদের পরিবারে চলছে শোকের মাতম। আমার বাবা শহিদ মো. ইসহাক জমাদ্দার শেখ হাসিনার সরকারের বরাবরই বিরোধী ছিলেন। তিনি সবসময় চাইতেন ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হোক, মানুষের মুক্তি আসুক। আমার বাবার মতো হাজারো শহিদের রক্তের সাগর পাড়ি দিয়ে দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। মানুষ স্বৈরাচারমুক্ত হয়েছে। কিন্তু আমার বাবা তা দেখে যেতে পারেননি। স্বাধীনতার স্বাদ তিনি উপভোগ করতে পারেননি। এটাই আমাদের দুঃখ।
সম্প্রতি রাজধানীর আদাবর থানাধীন শম্পা মার্কেটে ওয়ালটনের শো রুমে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে তার কথা হয়। তিনি ওই শো রুমে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করেন।
মো. ইসহাক জমাদ্দার (৪৭) বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন গত ৫ আগস্ট মিছিলে যোগ দিয়ে শ্যামলী ক্লাব মাঠের বিপরীতে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন। পুলিশের ছোঁড়া গুলিটি সেদিন তার বাম হাতের বাহু ভেদ করে বগলের পাশ দিয়ে বুকের ভেতর ঢুকে গেলে সাথে সাথেই তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন।
সবুজ জমাদ্দার বলেন, বিগত স্বৈরাচার বিরোধী যে কোন আন্দোলনে ইসহাক জমাদ্দার সবার আগে থাকতেন। এলাকার কেউ না গেলেও তিনি ঠিকই চলে যেতেন। এমনও হয়েছে তিনি পায়ে হেঁটে গাবতলী, নয়াপল্টন পর্যন্ত চলে গেছেন। বিগত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনেও তিনি শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন। ইসহাক জমাদ্দার বিএনপি’র রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। আদাবর থানার ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের ৬ নম্বর বায়তুল আমান ইউনিট বিএনপির তিনি সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
বরগুনা জেলার বামনা উপজেলার সদর ইউনিয়নের বেবাজিয়াখালি গ্রামের মৃত. আব্দুল আজিজ জমাদ্দারের পুত্র শহিদ মো. ইসহাক জমাদ্দার পেশায় একজন দিনমজুর। দিনের বেলা বিভিন্ন গার্মেন্টসের মালামাল পরিবহন আর রাতের বেলা নাইটগার্ডের কাজ করতেন। স্ত্রী ফাতেমা বেগম (৪৪)। দুই ছেলে মো. সবুজ জমাদ্দার (২৯) ও মো. সজীব জমাদ্দার (২৫)। দুজনই বিবাহিত। বড় ছেলের দুই বছরের একটি মেয়ে, আর ছোট ছেলের সাড়ে তিন বছর বয়সের একটি ছেলে সন্তান রয়েছে। এদের সবাইকে নিয়ে উত্তর আদাবরের বায়তুল আমান এলাকার ৬ নম্বর রোডের ২৩ নম্বর বাড়ির (নিচ তলা) টিনশেড ভাড়া বাসায় থাকতেন তিনি।
বাবার শহিদ হওয়ার বিষয়ে সবুজ বলেন, ‘আমার বাবা ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলের সময় শ্যামলীতে ছিলেন। ওই সময় আদাবর পুলিশ থানা থেকে গুলি করতে করতে বের হয়। তাদের গুলিতে আমার বাবা শ্যামলী ক্লাব মাঠের বিপরীত দিকে ঘটনাস্থলেই মারা যান। আমরা একঘন্টা পর খবর পাই যে বাবা গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে গিয়ে ওনার মৃতদেহ দেখতে পাই।
সরকার পতনের খবর পেয়ে তিনি বিজয় মিছিল নিয়ে আদাবর থানার সামনে দিয়েই যাচ্ছিলেন। তখনই তিনি সেখানে গুলিবিদ্ধ হন। ওই সময় আরো ৪-৫ জনের গায়ে গুলি লাগে এবং তারাও শহিদ হয়েছেন। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালেই আমার বাবার পাশে আরো অনেকগুলো লাশ আমরা দেখেছি। লাশগুলো একজনের ওপর একজন স্তূপ করে রাখা হয়েছিল। যারা শহিদ হয়েছেন, গুলিবিদ্ধ হয়েছেন এদের সবাই এই আদাবর এলাকারই শনিরবিল, আদাবর ১০, টিক্কাপাড়া এসব এলাকার বলে জানান সবুজ।
সবুজ আরো জানান, ‘গত ৫ আগস্ট সকাল থেকেই তিনি আন্দোলনের মাঠে ছিলেন। দুপুরে বাসায় এসে খাবার খেয়ে আবারো বেরিয়ে যান। আমি দুপুর ২টার দিকে তাকে ফোন দেই তখন আমাকে বাবা জানায়, তিনি শ্যামলী এলাকাতেই আছেন। পরে আমি বাসায় যাই। বিকেল ৫টার দিকে খবর পাই আমার বাবার শরীরে গুলি লেগেছে।’
বাবার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ‘উনি প্রতিটা আন্দোলন সংগ্রামে সক্রিয় ছিলেন। প্রতিদিনই রাতে যখন আমরা একসাথে খাবার খেতে বসতাম তখন আন্দোলন নিয়ে বিভিন্ন গল্প করতেন। কখন কোথায় কি হয়েছে এসব গল্প করতেন। বলতেন, তার পাশেই আজ একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এই ধরনের গল্পগুলো তিনি সবসময় আমাদের সাথে করতেন।’
‘সারা দেশের মানুষ যখন স্বৈরাচারের পতনের আনন্দে উদ্বেলিত ঠিক সেই সময়ে আমাদের পরিবারে নেমে আসে শোকের ছায়া। আমার বাবাই ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তার উপার্জনেই সংসারের বাজার খরচ চলতো। আর আমরা দুই ভাই যা ইনকাম করতাম তা দিয়ে বাড়ি ভাড়া দিতাম। সংসার খরচের বড় অংশটাই বহন করতো আমার বাবা।এছাড়া বাবা কিছু ঋণও রেখে গেছেন, বলেন শহিদের ছোট ছেলে রং মিস্ত্রী সজিব জমাদ্দার।
তিনি বলেন, আমাদের দুই ভাইয়ের দুই সন্তান সবসময় আমার বাবার কোলে চড়ে বেড়াতো। ঘরে ফিরেই তিনি দু’জনকে দুই কোলে নিয়ে বসতেন। তাদের আদর করতেন। বাবার মৃত্যুর পর মা-ও যেন কেমন হয়ে গেছেন। সব সময় তিনি বাসায় একা একা দরজা বন্ধ করে কান্নাকাটি করেন।
সবুজ জমাদ্দার জানান, ৫ আগস্ট সন্ধ্যা সাড়ে ৭ টার দিকে তারা তার বাবার মৃতদেহ গ্রহণ করেন। ঐদিন রাত ১২টায় বাবার মৃতদেহ নিয়ে গ্রামের বাড়িতে রওনা দেন। এখানেই গোসল দিয়ে তার একটি জানাজা হয়। পরদিন সকাল ৬ টায় গ্রামের বাড়িতে তারা পৌঁছান এবং সকাল সাড়ে ১০ টায় আরেকটি জানাজা সেখানে অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১১ টায় বাবা-মায়ের কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
সরকারিভাবে কোন সহযোগিতা এখনো না পেলেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামের পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।
শহিদ ইসহাক জমাদ্দারের বাসায় স্ত্রী ফাতেমা বেগমের সাথে কথা হয় বাসস’র এই প্রতিবেদকের সঙ্গে। স্বামীকে হারিয়ে তিনি অনেকটাই নির্বাক। অল্প কথায় তিনি যা বললেন তা
হলো- ‘আমি আর কিছুই চাই না, আমি চাই আমার স্বামীকে যারা খুন করেছে তাদের যেন ন্যায্য বিচার হয়। আমি যেন বেঁচে থাকতে আমার স্বামী হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।
আর সরকার যেন আমাদের অসহায় পরিবারের দিকে একটু দৃষ্টি রাখেন।’
ইসহাক জমাদ্দারের সাথে ভ্যান গাড়ি চালাতেন শেরপুরের আছিম উদ্দিন (৫০)। তিনি ইসহাক জমাদ্দারের স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘ইসহাক ভাই খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। এলাকার কেউ বলতে পারবে না তিনি কোনদিন কারো সাথে কোন খারাপ আচরণ করেছেন। তিনি বিএনপির জন্য পাগল ছিলেন। নিজের পকেটের পয়সা খরচ করে আমাদেরও মাঝে মাঝে বিএনপির মিছিলে নিয়ে যেতেন। নিজের পরনের জামা-কাপড় মাঝে মাঝে আমাদের দিয়ে দিতেন।’
বিএনপি বায়তুল আমান ইউনিটের সভাপতি দেলোয়ার হাওলাদার (৫৫)। সেদিন তিনিও আন্দোলনের মাঠে ছিলেন। তিনি জানান, ‘৫ আগস্ট সকালের পর আমরা মিছিল নিয়ে শ্যামলীর দিকে যাই। সেখানে আমার ইউনিটের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান ফকির (৫০) আহত হলে তাকে নিয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলে যাই। দুপুরের পর খবর পাই আমাদের সাংগঠনিক সম্পাদক ইসহাক জমাদ্দার গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘ইসহাক জমাদ্দার দল অন্তপ্রাণ একজন মানুষ ছিলেন। দলের কাছ থেকে কোনদিন কিছু চাননি। সারা জীবন শুধু দলকে নিঃস্বার্থভাবে দিয়েই গেছেন। তার মতো এমন নিবেদিত কর্মী পাওয়া খুবই কঠিন।’
সবুজ জমাদ্দার বলেন, ‘আমরা চাই শহিদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন বাংলাদেশ যেন ভালোভাবে চলে। কেউ যেন আর এরকম স্বৈরাচারী না হয়। মানুষের যাতে বাকস্বাধীনতা থাকে। সবকিছু মিলিয়ে যেন আমরা ভালো থাকতে পারি। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করে গরিব মানুষ যেন খেয়ে পরে ভালো থাকতে পারে, সরকার যেন সেই ব্যবস্থাই করে। তাহলেই আমার বাবার মতো হাজারো মানুষের আত্মদান সার্থক হবে।’