রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে সহায়তা করছে

বাসস
প্রকাশ: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ২২:০৮

//এ কে এম কামাল উদ্দিন চৌধুরী//

ঢাকা, ২৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে অভূতপূর্ব রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, যা দেশের আর্থিক পরিস্থিতি পুনর্গঠন এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি রেমিট্যান্স এসেছে, যা পূর্বের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ২৪.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল।

এই প্রবাহের গতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরেও অব্যাহত রয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রথম দুই মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ৪.৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১৮.৪ শতাংশ বেশি।

এই প্রবাহ বৈশ্বিক অনিশ্চয়তার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ‘আশার আলো’ জাগিয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী ১ কোটি ২০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি শ্রমিকের এই রেমিট্যান্স প্রবাহ আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলেন, এই রেকর্ড রেমিট্যান্স প্রবাহ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকা শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই রেমিট্যান্স শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি নয়, বরং টাকার বিনিময় হার স্থিতিশীল করতে সাহায্য করেছে। ফলে জাতীয় মুদ্রার ওপর চাপ কমেছে।

এছাড়াও, মুদ্রাস্ফীতি, অর্থনৈতিক মন্দা ও ঋণের মাত্রা বৃদ্ধির মতো ক্রমাগত চ্যালেঞ্জের মধ্যেও রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক লেনদেনে ভারসাম্য এবং বৈদেশিক মুদ্রার একটি শক্তিশালী ও টেকসই প্রবাহ নিশ্চিত করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক এবং মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান বলেন, সরকার প্রবাসীদের বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে উৎসাহিত করতে এবং জাতির সর্বাধিক সুবিধার্থে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে প্রেরিত রেমিট্যান্সের জন্য ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দিচ্ছে।

তিনি উল্লেখ করেন, প্রবাসীরা এখন ‘হুন্ডি’ পদ্ধতি ছেড়ে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে সহায়তা করছে।

রেমিট্যান্স প্রবাহের বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় চলতি বছরের ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে ৩১.২৮ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে।

ব্যাংকাররা বলেন, বিদ্যমান স্থিতিশীল বিনিময় হার রেমিট্যান্স প্রেরকদের বৈধ চ্যানেল বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ ব্যাংক ও খোলা  বাজারের মধ্যে মুদ্রার দামের পার্থক্য খুবই কম।

বাজার সংশ্লিষ্টদের মতে, রেমিট্যান্স প্রেরকরা ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে প্রতি ডলার ১২১.৭৫ টাকা সর্বাধিক বিনিময় হার পাচ্ছেন। খোলা বাজারে এই হার প্রতি ডলার ১২২.৫০ টাকা।

ডাচ-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ শহিদ উল্লাহ বলেন, রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর অপারেটরদের ওপর অভিযান চালানোর ফলে অবৈধ আন্তঃসীমান্ত অর্থ স্থানান্তর চ্যানেল হুন্ডি ও হাওয়ালার চাহিদা হ্রাস পেয়েছে। যার ফলে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রেমিট্যান্সের কারণে ডলারের প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার বাজার স্থিতিশীল হয়েছে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধির ইতিবাচক প্রভাব বাংলাদেশে ব্যাপকভাবে দৃশ্যমান, বিশেষ করে গ্রামীণ এলাকায়, যেখানে অনেক পরিবার প্রবাসী স্বজনদের পাঠানো অর্থের ওপর নির্ভরশীল।

তিনি বলেন, এই অর্থের একটি বড় অংশ দৈনন্দিন খরচ মেটাতে ব্যবহৃত হলেও  ক্ষুদ্র ব্যবসা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবাসহ গুরুত্বপূর্ণ দীর্ঘমেয়াদি খাতে বিনিয়োগ করা হচ্ছে, যা ঊর্ধ্বমুখী গতিশীলতার সুযোগ তৈরি করছে। 

মোহাম্মদ শহিদ উল্লাহ আরও বলেন, স্থানীয় দোকান মালিকরা সেই অর্থ ব্যবহার করে তাদের পণ্য সংগ্রহ করেছেন, আর অন্যরা দক্ষতা উন্নয়নে বিনিয়োগ করেছেন। যার ফলে নতুন পরিষেবা ও স্থানীয় কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এতে স্থানীয় জীবনমান উন্নত হচ্ছে।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে রেকর্ড রেমিট্যান্স শুধু একটি স্বল্পস্থায়ী অর্থনৈতিক অর্জন নয়, এটি তাৎক্ষণিক পুনরুদ্ধার এবং দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে একটি অপরিহার্য লাইফলাইন।

তবে তিনি উল্লেখ করেন, রেমিট্যান্সের সুবিধাগুলো সমানভাবে বিতরণের দিকে নজর রাখতে হবে, অবকাঠামো উন্নয়ন করতে হবে এবং শিক্ষার প্রচারে মনোযোগ দিতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের একটি গবেষণা অনুযায়ী, রেমিট্যান্স দরিদ্রতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে, বহু বাংলাদেশিকে দরিদ্র থেকে মুক্তি দিয়েছে। এর প্রভাব মানব উন্নয়ন সূচকে স্পষ্ট। কারণ যেসব পরিবার অর্থ পায়, তারা এখন বেসরকারি স্কুলে ভর্তি এবং গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সেবা নিতে সক্ষম।

ঢাকা শহরের মতো নগর এলাকায়, প্রবাসী আয় দ্বারা চালিত ভোক্তাদের ব্যয় খুচরা খাতে প্রবৃদ্ধি সৃষ্টি করছে। ক্ষুদ্র বাজার এবং দোকানগুলোতে খাবার, কাপড় ও অন্যান্য ভোক্তা পণ্যের বিক্রি বেড়েছে। এতে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এবং স্থানীয় অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকার ব্যবসায়ীরা বিলাসী ও নিত্যপণ্যের চাহিদায় বাড়তি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করছেন।

রেমিট্যান্সের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশ সরকার এই প্রবাহের একটি বড় অংশ বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে আধুনিক সেতু, মহাসড়ক এবং নগর পরিবহন ব্যবস্থা উন্নয়ন অন্তর্ভুক্ত, যা দেশজুড়ে সংযোগ বাড়ানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।

 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সার্ক পুনরুজ্জীবনে জোরালো আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
জাতিসংঘে ভাষণে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অগ্রগতি ও সংস্কার তুলে ধরলেন প্রধান উপদেষ্টা
পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এখনই জরুরি: প্রধান উপদেষ্টা
‘সম্প্রীতির বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হই’ : মাটিরাঙায় সম্প্রীতি সভায় উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমার আহ্বান
নির্বাচনে যদি কোন দলকে সুবিধা দেয়া হয়, জনগণ মেনে নেবে না : রিজভী 
নারীর ক্ষমতায়ন সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার : প্রধান উপদেষ্টা
ইসরাইলি বসতিতে কার্যক্রম চালানো ১৫৮ কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করল জাতিসংঘ
রোহিঙ্গা সংকট: স্থায়ী সমাধান ও তহবিল বৃদ্ধির আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
অবৈধ সম্পদ সংরক্ষণকারী দেশকে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে দেওয়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
অভিষেকের ঝড়ো হাফ সেঞ্চুরিতে ভারতের সংগ্রহ ৫ উইকেটে ২০২ রান
১০