বাসস
  ৩০ অক্টোবর ২০২৩, ১০:১৪

কোটালীপাড়ায় তিন দিনব্যাপী নৌকা বাইচ উৎসব চলছে

॥ মনোজ কুমার সাহা ॥
টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ), ৩০ অক্টোবর, ২০২৩ (বাসস): গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় উৎসব মুখোর পরিবেশে ৩ দিনব্যাপী দেশের  দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ নৌকা বাইচ উৎসব চলছে ।
এ নৌকা বাইচ প্রচীন ঐতিহ্যবাহী স্থানীয়দের কাছে বিল বাঘিয়ার নৌকা বাইচ হিসেবে সমধিক পরিচিত। প্রতি বছরের মতো এ বছরও এ নৌকা বাইচকে কেন্দ্র করে হাজার হাজার মানুষের মিলন মেলা বসেছে  কোটালীপাড়া উপজেলার কালিগঞ্জে।
গতকাল রোববার (২৯ অক্টোবর) দুপুর থেকে নান্দনিক এ নৌকা বাইচ বিপুল আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে  শুরু হয়ে চলে সন্ধ্যা পর্যন্ত। আজ সেমাবার দুপুরে নৌকাবাইচ উৎসবের ২য় দিনেও দুপুর থেকে নৌকা বাইচ উৎসব শুরু হয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলবে। আগামীকাল মঙ্গলবার (৩১ অক্টোবর)  সন্ধ্যায় এ নৌকা বাইচ উৎসব সমাপ্ত হবে। প্রাচীন বাংলার  ঐতিহ্যে লালিত দু’শ বছরের আকর্ষণীয় এ নৌকা বাইচে গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর , পিরোজপুর , বরিশাল জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের  শতাধিক সরেঙ্গা,ছিপ,কোষা,চিলাকাটা,জয়নগর বাচারী নৌকা অংশ নেয়। আবহমান গ্রাম বাংলার অতি প্রাচীন কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও নিজস্বতা ধরে রাখতে হাজারো প্রাণের আনন্দ উচ্ছালতায় কোটালীপাড়া উপজেলার বিল বাঘিয়ার বাবুর খালে কালিগঞ্জ বাজার থেকে খেজুরবাড়ি পর্যন্ত ২ কিঃমিঃ এলাকা জুড়ে নৌকা বাইচ  ও মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এখানে বাড়তি আকর্ষণ নৌকায় নৌকায় মেলা । হাজার হাজার মানুষ দুই পাড়ে দাঁড়িয়ে  নৌকা বাইচ প্রত্যক্ষ করেন ।  দুপুর থেকে নানা বর্ণে ও বিচিত্র সাজে সজ্জিত দৃষ্টি নন্দন এসব নৌকা তুমুল বাইচ শুরু করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে নৌকা বাইচের একের পর এক ছোপ।
ঠিকারী ও কাঁশির বাদ্যের তালে জারি সারি গান নেচে গেয়ে - হেঁইও হেঁইও রবে বৈঠার ছলাৎ- ছলাৎ শব্দে এক অনবদ্য আবহ সৃষ্টি হয়। খালের দু’ কূলে দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার মানুষের হৃদয়ে জাগে দোলা। মাল্লাদের  সাথে সমবেত হন অগনিত সমর্থক ও দর্শক। তারা উৎসাহ দেন বাইচের নৌকার মাল্লাদের। খালের দু’পাড়ে  দাঁড়িয়ে থাকা মানুষের করতালী ও হর্যধ্বনিতে এলাকা মুখরিত হয়ে ওঠে। গোটা এলাকায় সঞ্চারিত হয় উৎসবের আমেজ।
কবি সাংবাদিক ও ইতিহাস গবেষক রবীন্দ্রনাথ অধিকারী বলেন, নি¤œ জলাভূমি (বিল) বেষ্টিত কোটালীপাড়া ছিল তালিমপুর-তেলিহাটি পরগনার অন্তর্গত। এ অঞ্চলের মানুষের জীবন জীবিকার প্রধান অবলম্বন ছিল নৌকা। প্রায় দু’শত বছর আগে লক্ষ্মী পূজার সময় নৌকা নিয়ে তালিমপুর-তেলিহাটির জমিদার শিবরাম চৌধুরীর বাড়িতে যেতেন এ এলাকার মানুষ।  পূজা দেখে ফেরার সময় নৌকায় নৌকায় পাল্লা হতো। নৌকার মাধ্যমে চিত্তবিনোদনের চিন্তা থেকে বিলবাঘিয়ায় নৌকা বাইচের প্রচলন করেন জমিদার শিবরাম চৌধূরী । সেই থেকেই লক্ষ্মী পূজার পরের দিন থেকে এ অঞ্চলের নৌকা বাইচ উৎসব হয়ে আসছে স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে। এ বাইচ কেউ আয়োজন করে না। ৩ দিনব্যাপী দেশের আর কোথাও আয়োজন ছাড়া এতবড় নৌকা বাইচ উৎসব হয় বলে আমার জানা নেই।
কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কামরুল ইসলাম বাদল বলেন , ছোট বেলা থেকে এ নৌকা বাইচ দেখে আসছি। এখানে কখনোই কাউকে বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে বাইচের আয়োজন করতে হয় না। স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে মাঝি মাল্লারা নৌকা নিয়ে এসে নৌকা বাইচ উৎসব করে আসছেন। এখানে কোন আয়োজক কমিটি নেই। কোন পুরস্কারের ব্যবস্থা করা হয় না। তারপরও ২০০ বছর ধরে  এ নৌকা বাইচ উৎসব হয়ে আসছে। এটি কোটালীপাড়ার একটি ঐতিহ্য।
কালিগঞ্জের নৌকা বাইচ দেখতে আসা গৃহিনী শ্যামলী বল ও মেহের আফরোজ বলেন, জীবনে অনেক স্থানের নৌকা বইচ দেখেছি। কিন্তু এখানকার মতো এত বড় , কালার ফুল ও রাজকীয় ঢং এর নৌকা বাইচ আমার দেখিনি।
বাইচার কোটালীপাড়া উপজেলার নৈয়ারবাড়ি গ্রামের  সুকমল সরকার বলেন, আমরা ৩ দিনের  নৌকা বাইচ উৎসবে অংশ নিয়ে দর্শনার্থীদের আনন্দ দেই। আমরাও আনন্দ উপভোগ করি। শত শত বছর ধরে আমাদের পূর্ব পুরুষরা এই উৎসবে অংশ নিয়ে ঐতিহ্য সৃষ্টি করেছে। আমরা সেই ধারবাহিকতাকে ধরে রেখেছি। আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম এটিকে ধরে রাখবে। আগে বিলে নৌকা বাইচ হত। এখন বিলে পানি নেই। তাই খালে বাইচ হয়। খাল যতদিন টিকে থাকবে ততদিন নৌকা বাইচ হবে। এ কারণে আমরা বাবুর খাল সংরক্ষণের দাবি জানাই।
কোটালীপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন,  বাঘিয়ার বিলের নৌকাবাইচ আমাদের আবহমান বাংলার কৃষ্টি কালচারকে ধরে রেখেছে। গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার মানুষ নৌকাবাইচ উপভোগ করতে এখানে আসেন। নৌকাবাইচ উৎসব পরিনত হয় হাজার-হাজার মানুষের মিলন মেলায়। এখানে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নৌকাবাইচ এলাকায় পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। নৌকা বাইচ নির্বিঘেœ শেষ করতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
কলাবাড়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ্যাড. বিজন বিশ^াস বলেন, নদী মাতৃক এ অঞ্চলের ২ শ’বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঘিয়া বিলের নৌকা বাইচ টিকিয়ে রাখতে কোটালীপাড়া উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল প্রকার সহযোগিতা করা হয়েছে। আবহমান গ্রাম বাংলার অতি প্রাচীন কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও নিজস্বতা ধরে রাখতে আমাদের এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে।