মায়ের ঘাম থেকে কুস্তিগির কন্যার সোনা জয়ের গল্প

বাসস
প্রকাশ: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:১৬
ছবি : বাসস

ঢাকা, ৯ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : পল্টন হ্যান্ডবল স্টেডিয়ামের অস্থায়ী কুস্তি ম্যাটে তুমুল উত্তেজনা। একে একে বাংলাদেশ আনসারের রোজিনা আক্তার ও পুলিশের সুবর্ণাকে কুস্তির প্যাঁচে ধরাশায়ী করলেন রাজশাহীর জেমি আক্তার। ততক্ষণে সোনার পদকও নিশ্চিত হয়েছে জেমির।

তারুণ্যের উৎসব উদযাপন উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ কুস্তি ফেডারেশন আয়োজিত দুই দিনব্যাপী ভিসতা ১৩তম জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি সোমবার শেষ হয়েছে। এতে মহিলা বিভাগের ৭৬ কেজি ওজন শ্রেণীতে সোনা জিতেছেন জেমি।
বাবার চেহারা কেমন সেটা মনে নেই জেমির। থাকবে কি করে? জেমির জন্মের আগেই যে মারা যান বাবা! জেমির মা গৃহপরিচারিকার কাজ করেন অন্যের বাড়িতে।

রাজশাহীর সেই সাধারণ গৃহপরিচারিকার ঘামে ভেজা দিনগুলো কুস্তির মঞ্চে জন্ম দিয়েছে এক অসাধারণ স্বপ্নের। অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালানো সেই মায়ের মেয়ে জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি প্রতিযোগিতায় জিতে নিয়েছেন সোনার পদক। মায়ের সংগ্রাম আর মেয়ের দৃঢ়তায় লেখা এই গল্প শুধু কুস্তির মঞ্চেই নয়, হৃদয়ের মঞ্চেও এক অনন্য জয়গাথা।

রাজশাহী শহরের অচেনা এক গলিপথের ছোট্ট ঘর। ভোর হলেই মা বেরিয়ে যান অন্যের বাড়িতে কাজ করতে। কখনো বাসন মাজা, কখনো কাপড় ধোয়া। সেই কষ্টের টাকাতেই চলে সংসার। সেই টাকা দিয়েই মেয়ে প্রথম কুস্তির ম্যাটে দাঁড়ায়। পড়াশোনার খরচ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, আর প্রতিদিনের খাদ্য- সবই এসেছে মায়ের ঘাম ঝরানো হাতে।

এত খেলা থাকতে কেন কুস্তিকে বেছে নিলেন? প্রশ্নটা করতেই জেমির উত্তর, ‘তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তাম। আমাদের এলাকার নাসরিন আপু বাসার সামনের খালি মাঠে প্র্যাকটিস করাতেন। একদিন বাসায় এসে আম্মু বলে তুই কি প্র্যাকটিস করবি? আমি এরপর রাজশাহী স্টেডিয়ামে গিয়ে কুস্তি খেলা দেখি। এরপর এটা ভালো লেগে যায়।’

২০২২ সালে আনসারের হয়ে প্রথম জাতীয় প্রতিযোগিতায় রুপা জয় করেন জেমি। সেবারই প্রথম ঢাকায় আসেন। এর আগে রাজশাহীতে ১৫ দিনের ক্যাম্প করেন। পরের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালে জাতীয় যুব গেমসেও জিতেন রুপা।

জেমির পারফরম্যান্স নজর কাড়ে জাতীয় দলের কোচ শারমিন সুলতানার। এরপর তাকে দলের সঙ্গে ভারতের বিশেষ অনুশীলন ক্যাম্পে পাঠানো হয়। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসের জন্য জাতীয় দলের ক্যাম্পে আছেন জেমি।

ক্যারিয়ারে প্রথমবার সোনা জিতে রোমাঞ্চিত জেমি, ‘এর আগে তারুণ্যের উৎসবে সোনা জিতি। কিন্তু সেটা ছিল আন্তঃজেলা পর্যায়ে। তাই তখন অত আনন্দ হয়নি। কিন্তু এবার আনসার, পুলিশের সিনিয়র খেলোয়াড়দের হারিয়েছি। এজন্য বেশি ভালো লাগছে।’

এবারের সোনার পদক আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভালো খেলার আত্মবিশ্বাস যোগাচ্ছে জেমিকে, ‘আমি এখানে খেলতে এসে মোটেও ভয় পাইনি। বরং সাহস বেড়ে গেছে। আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। প্রথম যখন আনসারের খেলোয়াড়কে হারিয়েছি তখন মনে হচ্ছিল পুলিশের খেলোয়াড়কেও হারাব। আমার খেলা দেখে কোচ বলেছে, তোকে দিয়ে হবে।’

পদক মঞ্চে উঠে মাকে সব কৃতিত্ব দিলেন জেমি, ‘আম্মু আমার জন্য অনেক কষ্ট করে। যদিও আমি ছোট থেকে নানির কাছে বড় হয়েছি। নানিও প্রচুর ভালোবাসে। তারা না খেয়ে থেকেছেন অনেক দিন। কিন্তু আমাকে না খাইয়ে রাখেনি। আমার খেলার সরঞ্জাম, খেলতে যাওয়ার যাতায়াত ভাড়াসহ সব টাকা পয়সার জোগাড় করেছে। নানি বলেন, এভাবেই তুই একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবি। আমার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে টাকা জোগাড় করেন। আমি মায়ের দুঃখ ঘোচাতে চাই।’

কুস্তি  খেলায় আসার শুরুটা সহজ ছিল না জেমির। ছেলেদের খেলার মাঠে মেয়ের নাম শোনার পর সমাজে অনেক কথা উঠেছে। ‘মেয়ে হয়ে আবার কুস্তি?- এমন প্রশ্ন বারবার শুনতে হয়েছে। কিন্তু তিনি দমে যাননি। কোচের পরামর্শ আর মায়ের অদম্য সাহসে এগিয়ে গেছেন। স্কুল শেষে অনুশীলন, রাতে পড়াশোনা, আবার ভোরে উঠে অনুশীলন। এটাই তার প্রতিদিনের রুটিন।

জাতীয় সার্ভিসেস কুস্তি প্রতিযোগিতায় যখন রেফার জেমির হাত উঁচু করে বিজয়ী ঘোষণা করেন, তখন কান্নায় ভেঙে পড়েন জেমি।

নিশ্চই অন্যের ঘরে কাজ করা সেই মাও নিজের মেয়ের সাফল্যে গর্বিত। মেয়ে গলায় সোনার পদক ঝোলালেও, আসল জয় যেন মায়েরই। যিনি সংগ্রামকে সিঁড়ি বানিয়ে মেয়েকে স্বপ্নের চূড়ায় পৌঁছে দিয়েছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ভাষাসৈনিক আহমদ রফিকের পরলোকগমন
বিশেষ অভিযানে রাজধানীতে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ২৯ জন গ্রেফতার
বাংলাদেশকে ১৫২ রানের লক্ষ্য দিল আফগানিস্তান
পাকিস্তানকে হারিয়ে বিশ্বকাপ শুরু করলো বাংলাদেশ
ইলিশ সংরক্ষণে চাঁদপুরে কোস্ট গার্ডের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম
ফ্রান্স দলে ডাক পেলেন মাতেতা
টি২০ বিশ্বকাপের টিকিট পেল নামিবিয়া
সংস্কার, গণহত্যার বিচার ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তরুণ নেতৃত্ব অপরিহার্য : রাশেদ খাঁন
গবেষণালব্ধ বই যুগের আলোকবর্তিকা : ধর্ম উপদেষ্টা
বঙ্গোপসাগর অবস্থানরত গভীর নিম্নচাপটি রাত ৯টায় উপকূল অতিক্রম করতে পারে
১০