ঢাকা, ২৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : গাজা উপত্যকায় শিগগিরই দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে বলে জাতিসংঘ ও বিভিন্ন এনজিও সতর্কবার্তা দিয়েছে। তবে ইসরাইল-অবরুদ্ধ এই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে প্রবেশ করে তথ্য সংগ্রহের জটিলতা এই সংকটকে আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সংজ্ঞা অনুযায়ী, ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)’র তিনটি প্রধান শর্ত পূরণ হলেই দুর্ভিক্ষ ঘোষণার সুযোগ তৈরি হয়। আইপিসি হলো জাতিসংঘ ও ২১টি ত্রাণ সংস্থার একটি যৌথ উদ্যোগ।
এই তিনটি শর্ত হলো: ২০ শতাংশ পরিবারের চরম খাদ্যাভাব থাকা ও অনাহারে মৃত্যুর ঝুঁকি; ৫ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে তীব্র অপুষ্টির হার ৩০ শতাংশ ছাড়ানো; প্রতি ১০,০০০ জনে দৈনিক কমপক্ষে ২ জনের মৃত্যু।
এই শর্তগুলো পূরণ হলেই জাতিসংঘ ও সরকারগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করতে পারে।
বর্তমানে গাজায় খাদ্যসংকটের সূচকগুলো চরমমাত্রায় রয়েছে। জাতিসংঘের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রধান তেদ্রোস আধানোম গেব্রেয়েসুস বলেন, ‘গাজার বড় একটি জনগোষ্ঠী অনাহারে ভুগছে... এটি একপ্রকার মানবসৃষ্ট গণ-অনাহার।’
ত্রাণ সংস্থা ডাক্তারস উইদাউট বর্ডারস (এমএসএফ) জানায়, গত সপ্তাহে গাজার তাদের ক্লিনিকে পরিদর্শিত ৪ জনে ১ জন শিশু ও গর্ভবতী/স্তন্যদানকারী নারী অপুষ্টিতে আক্রান্ত।
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএইচও) জানায়, গাজার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দিনদিন না খেয়ে থাকছে, আর অপুষ্টির হার প্রতিনিয়ত বাড়ছে।
গাজা সিটির আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক জানান, গত ৭২ ঘণ্টায় ২১ জন শিশু অনাহারে মারা গেছে।
বাজারে কিছু খাদ্যপণ্য থাকলেও, মূল্য সাধারণ নাগরিকদের নাগালের বাইরে—এক কেজি ময়দার দাম উঠেছে ১০০ মার্কিন ডলারে। কৃষি জমিগুলোও যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে গেছে।
অনেক ত্রাণ সংস্থা ও ডব্লিউএইচও স্বীকার করছে. দুর্ভিক্ষ ঘোষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ করাই অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এমএসএফ-এর জরুরি সহায়তা প্রধান আমান্দে বাজারোল বলেন, ‘আমরা শিশুদের মাপ নিতে পারি না, উচ্চতা-ওজন তুলনা করতে পারি না, এগুলো করা এখন অসম্ভব।’
অ্যাকশন অ্যাগেস্ট হাংগার সংস্থার মধ্যপ্রাচ্য পরিচালক জঁ-রাফায়েল পুয়েতু বলেন, ‘ইসরাইলি সেনাবাহিনীর গাজাবাসীদের পুনঃস্থাপনের নির্দেশ ও চলাচলে বিধিনিষেধ তথ্য সংগ্রহকে অসম্ভব করে তুলেছে।’
ফরাসি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, গাজার খাদ্যাভাব এবং দুর্ভিক্ষের সম্ভাব্যতা মূলত ইসরাইলি অবরোধের ফল।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে—তারা সহায়তা আটকায়নি, বরং গাজায় প্রবেশ করা ৯৫০টি ত্রাণ ট্রাক আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিতরণের অপেক্ষায় রয়েছে।
ইসরাইল সরকারের মুখপাত্র ডেভিড মেনসার বলেন, ‘ইসরাইলের কারণে কোনো দুর্ভিক্ষ হচ্ছে না, বরং হামাসের ইচ্ছাকৃত সঙ্কট সৃষ্টি এর জন্য দায়ী।’
তবে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ইসরাইলি সামরিক বাহিনী কখনও এই অভিযোগের প্রমাণ পায়নি।
এদিকে ১০০-এর বেশি আন্তর্জাতিক এনজিও (যেমন: এমএসএফ, কারিতাস, সেভ দ্য চিলড্রেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ওক্সফাম) ইসরায়েলের প্রতি সব স্থলপথ খুলে দেওয়ার এবং পূর্ণ খাদ্য সরবরাহ ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে।
গাজা পরিস্থিতি নিয়ে এপিসি’র একটি নতুন মূল্যায়ন রিপোর্ট শিগগিরই প্রকাশিত হবে।
তবে অনেকেই বলছেন, এত বৈজ্ঞানিক মাপকাঠি ও দেরি করে ঘোষণার বাস্তব কোনো মূল্য নেই।
ডব্লিউএইচও-এর খাদ্য নিরাপত্তা বিশ্লেষণ পরিচালক জ্যঁ-মার্টিন বাওয়ার বলেন, ‘একবার দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হলে, ততক্ষণে বহু মানুষ ইতোমধ্যে মারা গেছেন।’
২০১১ সালে সোমালিয়ায় যখন আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা হয়, তখন আধেক মৃতদেহ ইতোমধ্যে দাফন হয়ে গিয়েছিল।
ইসরাইল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ভয়াবহ হামলার জবাবে গাজায় সামরিক অভিযান শুরু করে।
এই অভিযানে এখন পর্যন্ত প্রায় ৬০,০০০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই নাগরিক, গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে।
হামাসের ওই হামলায় ১,২১৯ জন ইসরাইলি নাগরিক নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক ব্যক্তি।