শিরোনাম
ঢাকা, ১১ অক্টোবর, ২০২৩ (বাসস): বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনীতিক, কূটনীতিক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলিকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কর্তৃক সংঘটিত বাংলাদেশের জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন,“একাত্তরের জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেয়ার এখনই উপয্ক্তু সময়”।
জেনেভায় জাতিসংঘ সদর দফতরে জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিল (ইউএনএইচআরসি)-এর ৫৪তম অধিবেশনের সাইড ইভেন্টে তারা এ আহ্বান জানান।
ইউরোপিয়ান বাংলাদেশ (ইবিএফ) ফোরাম এবং গ্লোবাল সলিডারিটি ফর পিস যৌথভাবে গতকাল মঙ্গলবার, সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় জাতিসংঘ ভবনে ‘ন্যায়বিচার এবং শান্তি: বাংলাদেশে জেনোসাইড ১৯৭১’ শীর্ষক এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন, সুইজারল্যান্ড এবং বাংলাদেশ সাপোর্ট গ্রুপ (বাসুগ) সম্মেলন আয়োজনে সার্বিক সহায়তা করে। বাসুগ চেয়ারম্যান বিকাশ চৌধুরীর সভাপতিত্বে এ সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, জেনেভায় জাতিসংঘ অফিস ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থায় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সফিউর রহমান।
বক্তারা বলেন, নীরবতার অর্থই প্রশ্রয়। মানবতাবিরোধী অপরাধ বন্ধ করতে হলে প্রতিটি গণহত্যা, প্রতিটি যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের স্বীকৃতি দিতে হবে। ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের সদস্যদের সান্তনা, সম্মান ও ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। তাই একাত্তরে বাংলাদেশে সংটিত জেনোসাইডের স্বীকৃতি দেওয়াও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নৈতিক দায়িত্ব ।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোহাম্মদ সফিউর রহমান বলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিচালিত হত্যাযজ্ঞ বিংশ শতাব্দীতে বিশ্ব প্রত্যক্ষ করা সবচেয়ে জঘন্যতম জেনোসাইডের একটি। নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আনুমানিক ত্রিশ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে, কয়েক লাখ নারীকে ধর্ষণ করেছে এবং লাখ লাখ মানুষকে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছে। এমনকি বাঙ্গালী জাতির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে তারা বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের দ্বারপ্রান্তে বাঙ্গালী বুদ্ধিজীবীদের একে একে হত্যা করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী পরিচালিত ১৯৭১ সালের গণহত্যা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এবং দলিলে নথিভুক্ত এবং সেই সময়ের কূটনৈতিক চিঠিপত্রেও তা প্রমাণিত।
তিনি ইতিহাসের এই জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও জেনোসাইডের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান।
ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং ইইউ টুডে-র প্রকাশক গ্যারি কার্টরাইট “বাংলাদেশের জেনোসাইডকে স্বীকৃতি দেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়” উল্লেখ করে বলেন, তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল এবং বাংলাদেশী জনগণের স্বাধিকারের প্রত্যাশাও বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পাকিস্তান এখনও ব্লাসফেমি আইন নিয়ে পড়ে রয়েছে।
অন্যদিকে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে বহুদূর এগিয়ে গেছে। বাংলাদেশের জিডিপি এখন ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়েও বেশি। মাত্র পাঁচ দশক আগে স্বাধীন হওয়া একটি দেশের জন্য এটি একটি অবিশ্বাস্য সাফল্য।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জেনোসাইডের স্বীকৃতির মাধ্যমে একাত্তরের গণহত্যার শিকার ও তাদের বংশধরদের সম্মান জানানো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং একান্ত প্রয়োজন।
পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান নাগরিক নেদারল্যান্ডসের লাইডেন ইউনিভার্সিটির গভর্ন্যান্স অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স অনুষদের লেকচারার আলিনা খান বলেন, “এটা আমার পক্ষে বোধগম্য হয় না যে, পাকিস্তান সরকার এবং সমাজ কিভাবে সম্পূর্ণরূপে সেই ইতিহাস মুছে ফেলার প্রত্যাশা করতে পারে, যে ঘটনায় একটি গোষ্ঠীর প্রায় অর্ধেক জনসংখ্যা নিধন করা হয়েছিল।”
একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষের ওপর পাকিস্তানের বর্বর হত্যাযজ্ঞের বিষয়ে জানতে পেরে ‘তিনি ও তার পরিবার পাকিস্তানের পরিচয় দিতে লজ্জাবোধ করেন’ উল্লেখ করে আলিনা খান বলেন, একাত্তরের জেনোসাইডের দায় পাকিস্তানের স্বিকার করে নেয়া উচিত এবং এ ব্যাপারে সংলাপ শুরু করার জন্য পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।
তিনি বলেন, সমন্বিত ইতিহাস এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া ছাড়া ন্যায়বিচারে পৌঁছানো সম্ভব নয়।
জার্মানির আন্তর্জাতিক সম্প্রচার সংস্থা ডয়চে ভেলের সাবেক সাংবাদিক এবং জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ডঃ হোসাইন আব্দুল হাই তাঁর গবেষণাপত্রে বলেছেন, একাত্তর মানব ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সময় বর্বরতা শুধুমাত্র সৈন্য, যোদ্ধা বা একটি সম্প্রদায়ের একক কোন গোষ্ঠির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এই যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সৈন্যরা একটি গোটা জাতি ও জাতিসত্তার ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, জ্বালাও- পোড়াও ও নির্মূলের প্রমাণ রেখে গেছে। যুদ্ধের সময় নারী ও শিশুরা প্রায়ই সহিংসতার, বিশেষ করে যৌন সহিংসতার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়।
তিনি বলেন, ৫২ বছর আগে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে এবং তাদের বাঙ্কারের আঁধারে নির্যাতনের শিকার অসহায় মা-বোনের আর্তনাদ পৃথিবীর মানুষের কানে না পৌঁছলেও, বর্তমানে জীবিত বীর বঙ্গমাতা বীরাঙ্গনাদের লোমহর্ষক বর্ণনা যখন বর্তমান বিশ্ব মোড়লদের সম্মুখে জীবন্ত দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা হ”্ছ।ে কোন মানবসমাজ এই জেনোসাইডের স্বীকৃতি না দিয়ে বসে থাকতে পারে না।
সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে আলোচনায় অংশ নেন, সাবেক ডাচ রাজনীতিক ও মানবাধিকার কর্মী হ্যারি ভ্যান বোমেল, ব্রিটিশ সাংবাদিক এবং ইইউ টুডে-এর প্রকাশক গ্যারি কার্টরাইট, নেদারল্যান্ডসের লাইডেন ইউনিভার্সিটির গভর্ন্যান্স অ্যান্ড গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স অনুষদের প্রভাষক এবং পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত গবেষক আলিনা খান, বন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক ড. হোসাইন আবদুল হাই, বেলুচ ভয়েস অ্যাসোসিয়েশনের ফ্রান্স এর সভাপতি মুনির মেঙ্গল, ইউনাইটেড কাশ্মীর পিপলস ন্যাশনাল পার্টির নির্বাসিত চেয়াম্যান সরদার শওকত আলী কাশ্মীরি, বেলজিয়ামের গ্লোবাল সলিডারিটির সভাপতি মোর্শেদ মাহমুদ, ইউরোপীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাংগঠনিক সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়া আবুল কালাম এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশন বাংলাদেশ, সুইজারল্যান্ডের সভাপতি খলিলুর রহমান মামুন।
সম্মেলনে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বাংলাদেশী কমিউনিটির সদস্য, ইউরোপীয় রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, গবেষক এবং ইউরোপের অন্যান্য সুশীল সমাজের মানবাধিকার কর্মীরা।