বাসস
  ২৩ মার্চ ২০২৪, ১৪:১৩

বরগুনায় ‘কান্দি’ পদ্ধতিতে লোনা জমি আবাদ

বরগুনা, ২৩ মার্চ, ২০২৪ (বাসস): বরগুনা উপকূলের বিস্তীর্ণ লোনা জমিকে উর্বর করে সবজি চাষ করছেন স্থানীয় কৃষকরা। তারা জানিয়েছেন, শেষ দুই মৌসুমে (এক বছরে) একটি  গ্রামে প্রায় ৯০ হাজার মণ সবজির উৎপাদন হয়েছে, বিক্রি হয়েছে কয়েক কোটি টাকায়। কৃষকদের এ উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়েছে পাশের জেলাতেও।
বরগুনার তালতলী উপজেলার সওদাগরপাড়া ও পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামের যে জমিতে লবণাক্ততার কারণে এক যুগ আগেও ধানের চাষও করা যেত না, সেখানেই এখন বছরজুড়ে রকমারি ফসল ফলাচ্ছেন চাষিরা। এখানকার চাষিরা বিশেষ এক চাষপদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন, স্থানীয়ভাবে যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘কান্দি’। কৃষিবিদেরা বলছেন, এ চাষপদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে রেইজড বেড (জমি উঁচু করার) পদ্ধতি বলা হয়।
তালতলী উপজেলা কৃষি দপ্তরের তথ্যানুযায়ি, দুই দিকে নদী, এক দিকে সাগর বেষ্টিত সওদাগরপাড়া গ্রামের খালগুলোয় লবণাক্ত পানির প্রবাহ থাকে। নদী থেকে গ্রামে ঢোকা সেই পানি মাটিতে মিশে লবণাক্ততার কারণে বছরের বেশির ভাগ সময় ৪ হাজার ৯৪০ একর জমি অনাবাদি থাকত। বছরে শুধু আমন ধান ফলাতেন কৃষকেরা। সওদাগরপাড়া আদর্শ কৃষি সমিতির হিসাবে, ‘কান্দি’ পদ্ধতি অবলম্বন করে শেষ দুই মৌসুমে (এক বছরে) গ্রামে প্রায় ৯০ হাজার মণ সবজির উৎপাদন হয়েছে, বিক্রি হয়েছে কয়েক কোটি টাকায়।
গ্রামে ‘কান্দি’ পদ্ধতির সূচনাকারী কৃষক শাহাদাত হোসেন জানান, তিনি সওদাগর পাড়ার পতিত লোনা জমিতে ফসল চাষের উপায় খুঁজতে থাকেন। ২০১২ সালে প্রথম তিনি নিচু জমির চারপাশের মাটি কেটে মাঝখানে উঁচু করে সবজির আবাদ করলেন। ক্ষেতের পাশের জমি থেকে মাটি কেটে নেওয়ায় প্রায় ছয় ফুট গভীর গর্ত হয়। এতে বৃষ্টির পানি ধরে রাখা যায়। এ পানি শুষ্ক মৌসুমে সেচ দেওয়া যায়। মাঘের শেষ সময়ে ্েক্ষতের পাশের কুয়ায় জমিয়ে রাখা বৃষ্টির পানি দিয়ে বোরো আবাদও হচ্ছে। আগে গ্রামে বোরো আবাদ হতো না।  সেচের জন্য মিঠাপানির অভাব পূরণ করলেন এভাবেই। শাহাদাত হোসেন জানান, সবজি চাষের জন্য জমি তৈরির সময় ওপরের অংশের মাটি নিচে এবং নিচের মাটি ওপরে চলে আসে। এতেই লবণাক্ততার প্রভাব কমানো সম্ভব হয়েছে। তাঁরা যে বেড তৈরি করছেন, তা সমতল থেকে সাড়ে তিন ফুট উঁচু। ফলে সেখানে লবণাক্ততা ছড়াতে পারে না।
শাহাদাতের পদ্ধতি অনুসরণ করে সফলতা পেয়েছেন গ্রামের অন্যান্য কৃষকরা। গ্রামের ২৪০ জন কৃষক ৪৯৪ একর জমিতে সবজি আবাদ করছেন। গঠন করেছেন সওদাগরপাড়া আদর্শ কৃষি সমিতি। মূলত শীত মৌসুমে শিম, মরিচ, বেগুন আর বর্ষা মৌসুমে মরিচ, শসা, মিষ্টিকুমড়া, তরমুজ চিচিঙ্গা, ঝিঙে, বরবটি ও লাউ বেশি আবাদ হয়। তারা জানান, শীতের শেষ দিকে বৃষ্টির জমানো পানি বোরো আবাদের জন্য সেচ দেওয়ার পর শেষ হয়। এরপর পায়রা নদীর শাখা তালতলী খাল থেকে পাইপের সাহায্যে পানি এনে সেচ দিতে হয়। এ জন্য বিএডিসি তাঁদের দুটি পাম্প মেশিন ও পাইপ দিয়েছে।
তালতলী উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কৃষি কর্মকর্তা মো. রাসেল বলেন, বছরব্যাপী সবজির আবাদের সূত্র ধরেই গত দুই বছর গ্রামের ৪০০ হেক্টরে জমিতে বোরো আবাদও হচ্ছে। কৃষকের পাশাপাশি স্কুল কলেজে পড়ুয়া ২০ শিক্ষার্থীও সবজির আবাদ করে স্বাবল¤ী^ হচ্ছেন।
সওদাগরপাড়ার দেখাদেখি পটুয়াখালীর কলাপাড়ার নীলগঞ্জ ইউনিয়নের কুমিরমারা গ্রামের কৃষকেরাও ‘কান্দি’ পদ্ধতিতে ফসল আবাদ শুরু করেন। ২০১৮ সালে তারা নীলগঞ্জ আদর্শ কৃষক সমিতি গঠন করেন। যার বর্তমান সদস্য ১৬২ জন। সমিতির সভাপতি জাকির হোসেন বলেন, তাঁদের সমিতির উদ্যোগে গোটা ইউনিয়নে প্রায় আট হাজার কৃষক ‘কান্দি’ পদ্ধতিতে চাষ করছেন। যে জমিতে ফসল হতো না, সেই জমিকে কৃষকেরা বহুফসলি জমিতে রূপান্তর করেছেন।
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান হাফিজ আশরাফুল ইসলাম বলেন, কৃষকদের এ উদ্যোগ জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত প্রভাবের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো ও ঝুঁকি হ্রাসের অসাধারণ দৃষ্টান্ত। এখন আমাদের উচিত তাঁদের এ কৌশলগুলো অন্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বরগুনার উপপরিচালক জোবাইদুল আলম জানান, এ অঞ্চলের লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে কৃষিতে বিরূপ প্রভাব পড়ছে। সে ক্ষেত্রে সওদাগর পাড়ার কৃষকেরা নিজেদের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে যেভাবে ফসল ফলাচ্ছেন, তা সারা দেশের কৃষকদের অনুকরণীয় হতে পারে।