বাসস
  ১৫ অক্টোবর ২০২৪, ১৩:২২

নোয়াখালীতে বন্যার পানি নেমে গেলেও জলাবদ্ধতা রয়েছে

নোয়াখালী, ১৫অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস): জেলার বন্যা ও স্থায়ী জলাবদ্ধতা গত ৫০-৬০ বছরের রেকর্ড ভেঙেছে। সরকারি হিসেবে বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে নোয়াখালীতে। যার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৪হাজার ১৯১কোটি টাকা।  বন্যা পরবর্তীতে দীর্ঘ হয়েছে জেলার জলাবদ্ধতার পরিস্থিতি।

সরজমিনে জলাবদ্ধ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার বেগমগঞ্জ উপজেলার চৌমুহনী পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডের বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও পানি রয়েছে প্রতিটি বাড়ির উঠোনে। কোথাও হাঁটু পরিমাণ, কোথাও এর চেয়ে কম।

জানা যায়, গত ২০ সেপ্টেম্বর রাতে ফেনী থেকে নেমে আসা  পানি উজানের প্রবেশ করায় নোয়াখালীর আটটি উপজেলা প্লাবিত হয়। এরই মধ্যে টানা ভারী বৃষ্টিতে প্রতিটি বাড়ির উঠোন ও সড়ক ৮/৯ ফুট পানির নিচে প্লাবিত হয়। নিজেদের বসত ঘর ছেড়ে আত্মীয়-স্বজনের বহুতল ভবনের বাসা ও পাশ্ববর্তী আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেন বন্যা কবলিত মানুষজন। এখনও অনেকে তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে রয়েছেন। বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছিলো জেলা  সদর, কবিরহাট, সুবর্ণচর, কোম্পানীগঞ্জ, সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলা। কিন্তু বন্যার দীর্ঘ দুই মাস অতিবাহিত হলেও এখনও পানি বন্দি হয়ে আছে চৌমুহনী পৌরসভার বেশির ভাগ ওয়ার্ড। বিভিন্ন সড়ক থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও বেশির ভাগ বাড়ির উঠোনে হাঁটু পরিমান পানি রয়েছে।

স্থানীয় বাসিন্দা সবুজ জানান, প্রায় ২মাস আগে তিনি বাড়ি থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে আশ্রয় কেন্দ্রে চলে যান। কয়েকদিন আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে যাওয়ার কারনে আশ্রয় কেন্দ্রে থেকে তাদের চলে আসতে হয়। এরপর থেকে চৌমুহনী বাজারের ছোট একটি বাসায় তারা ভাড়া নিয়ে সেখানেই অবস্থান করছেন।
 চৌমুহনী পৌরসভা ছাড়াও একই চিত্র জেলার সদর উপজেলার নেয়াজপুর, চরমটুয়া, কাদির হানিফ ইউনিয়ন, কবিরহাট উপজেলার নরোত্তমপুর, সুন্দলপুর ইউনিয়ন, সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া, কেশারপাড়, ডমুরুয়া ইউনিয়নের বেশির ভাগ গ্রামের। এছাড়াও বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী ও চাটখিল উপজেলার সবকয়টি ইউনিয়নে এখনও জলাবদ্ধতা রয়েছে। আর এ জলাবদ্ধতা দীর্ঘ হওয়ায় বেড়েছে পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ।

ভুক্তভোগী একাধিক ব্যক্তি বলেন, গত ১৬ বছর প্রভাবশালী মহল তাদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে জেলার অধিকাংশ বড় খাল দখল করে বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। দোকান ঘর করে ভাড়া দিয়েছে অনেক স্থানে। সংযোগ খালগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। পরিকল্পিত ভাবে এ খালগুলোর মাঝখানে তৈরি করা হয়েছে কালভার্ট, বাড়ি থেকে নির্বিেঘ্ন বের হওয়ার জন্য দেওয়া হয়েছে বাঁধ। খালে ময়লা-আবর্জনা ফেলায় বন্ধ হয়েছে পানির গতিপথ। যার ফলে দীর্ঘ দুই মাসেও বন্যা কবলিত এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে যেতে পারছে না।

এলাকাবাসি জানান, নোয়াখালীর ভাটি এলাকা লক্ষীপুর জেলা। নোয়াখালীর পানি লক্ষীপুর হয়ে মেঘনা নদীতে পড়ে।  তাই, নোয়াখালীর জলাবদ্ধ পরিস্থিতির উন্নতি করতে হলে লক্ষীপুর জেলার খালের উপর সকল বাঁধ, অবৈধ স্থাপনা, ভেসাল জালসহ পানি নামার জন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো সরানো প্রয়োজন। এক্ষেত্রে নোয়াখালী ও লক্ষীপুর প্রশাসনের যৌথভাবে কাজ করা দরকার।

সরজমিনে দেখ যায়, নোয়াখালী খালের সদর উপজেলার বিভিন্ন অংশ, শহরের ওপর ছাগলমারা খাল, চাটখিলের খিলপাড়া, রামনারায়ণপুর, বদলকোট, নোয়খলা, সেনবাগ উপজেলার ছাতারপাইয়া, কেশারপাড়, সোনাইমুড়ী উপজেলার বগাদিয়া উত্তর পোল থেকে কালিকাপুর পর্যন্ত, কলেজ গেইট থেকে নান্দিয়া পাড়া পর্যন্ত, বজরা থেকে চাঁদুপুর পর্যন্ত খাল দখল হয়ে আছে। বেগমগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থানেও খালর উপর একাধিক স্থাপনা রয়েছে। চৌমুহনী বাজারে খালের সিংহভাগ অংশ ব্যবসায়ীরা ময়লা আর্বজনা ফেলে ভরাট করেছে। এছাড়া কবিরহাট উপজেলার রিকশা ওয়ালার দোকান এলাকায় খালের মাঝখানে দেওয়া হয়েছে একাধিক বাঁধ। দখল করা হয়েছে ওয়াপদা খালের বেশির ভাগ অংশ। খাল দখল ও বাঁধই হয়েছে জেলার মানুষের গলার কাঁটা।  

চৌমুহনী বাজারের ব্যবসায়ী সোহান বলেন, বাজারের প্রধান সড়ক ছাড়া বাকি সবকয়টি এলাকা অনেক নিচু। বন্যার পর কয়েক বার পানি নেমেছিলো, আবার বৃষ্টিতে পানি জমতে থাকে। একদিন বৃষ্টি হলে ৩/৪দিন পানি জমে থাকে। আশপাশের সবগুলো ছোট খাল দখল করে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট ও বাড়ির সামনে বাঁধ দিয়ে সড়ক তৈরি করা হয়েছে। যার ফলে প্রতিটি জায়গায় পানি আটকে আছে। এ বাঁধগুলো না থাকলে হয়তো পানি সরসরি বড় খালে চলো আসতো। বড় খাল সংস্কার করার পাশাপাশি ছোট খালগুলোর দখলকৃত স্থান গুলো উদ্ধার করা না হলে এ পানি সহজে নামবে না।

জেলা শহর মাইজদীর আরিফুল ইসলাম নামের এক বাসিন্দা বলেন, শহরে জলাবদ্ধতার কারণ অপরিকল্পিত ড্রেনেজ ব্যবস্থা। তাঁর মতে শহরে যেভাবে ড্রেন করার কথা ছিলো সেটি সেভাবে না করে ড্রেনের জায়গায় কোনভাবে নালা করা হয়েছে। ফলে এ টুকু জায়গা দিয়ে পানি নামছে না, তারোপর ড্রেনে ময়লা ফেলে পানির গতিপথ বন্ধ করা হয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই শহরে দেখা দেয় জলাবদ্ধতা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, জেলা প্রশাসকের রাজস্ব বিভাগের কাগজে-কলমে অনেক খালের হিসাব থাকলেও বাস্তবে তা নেই। অথচ; একসময় জেলার বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনী থেকে এসব খাল হয়ে পণ্যবাহী নৌকা জেলার বিভিন্ন উপজেলা এবং পাশের লক্ষ্মীপুর, ফেনী ও চাঁদপুরে যেতো। বর্তমানে নৌকাতো দূরের কথা এসব খাল দিয়ে পানি নামতে পারছে না।

জেলা প্রশাসক খন্দতার ইশতিয়াক আহমেদ বলেন, বন্যা পরবর্তী সময় বিভিন্ন উপজেলায় একাধিক স্থান থেকে স্থানীয় লোকজনের সহযোগিতায় খালের ওপর থাকা কিছু স্থাপনা সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পানি প্রবাহ সচল করতে খাল পরিষ্কারের কাজও করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে খাল দখল করে যেসব স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে সেগুলো ভেঙে দেওয়া’সহ খাল পুনঃসংস্কারের ব্যবস্থা করার পরিকল্পনা রয়েছে।