শিরোনাম
সরেজমিন ঘুরে স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, টেকনাফ পৌরসভার জালিয়া পাড়া, সাবরাং, নয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপের লোকজন সীমান্তে লবণ চাষসহ নাফ নদের তীরে ঠেলা জালে মাছ ধরতে ব্যস্ত থাকতেন জেলেরা।
তবে নাফ নদে আগের মতো দেখা যায়নি জেলেদের নৌকা। এ ছাড়া গত মঙ্গলবার থেকে বৃহস্পতিবার (১২ ডিসেম্বর) দুপুর পর্যন্ত মিয়ানমারের গোলাবারুদের কোনো বিকট শব্দ শোনেননি সীমান্তের বাসিন্দারা।
নাফ নদের তীরে টেকনাফ-মিয়ানমার ট্রানজিট ঘাটের ভ্রাম্যমাণ দোকানি বৃদ্ধ নুরুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ কয়েক মাস ধরে রাতে মিয়ানমারে গোলাগুলোর কারণে নির্ঘুম রাত কেটেছিল। কেননা সে দেশের যুদ্ধের কারণে বোমার শব্দে এপারে কেঁপে উঠছিল। যার কারণে আমাদের বাড়িঘরগুলো থরথর করে কাঁপছিল। এতে নারী-শিশুরা খুব ভয়ভীতির মধ্যে ছিল। গত কয়েক মাস ধরে ওপারের যুদ্ধের কারণে আমরা এত দিন অস্বস্তিতে ছিলাম।
তিনি বলেন, গত তিন দিন ধরে পাশের দেশ (রাখাইন) থেকে গোলার বিকট শব্দ পাওয়া যায়নি। যার ফলে রাতে নির্ভয়ে ঘুমাতে পেরেছি। আমরা সীমান্তের মানুষের চাওয়া, যাতে পরিস্থিতি এভাবে শান্ত থাকে।
টেকনাফ শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা আব্দুর রহমান বলেন, গত দুই দিন ধরে সীমান্তে মিয়ানমারের গোলাগুলির শব্দ পাওয়া যায়নি। এই মুহূর্তে আপাতত দ্বীপের ৩০ হাজার মানুষ স্বস্তিতে আছেন। কারণ, এর আগে ওপারের গোলাগুলির কারণে আতঙ্কে ছিলাম আমরা।
তা ছাড়া দ্বীপে লোকজন এখন চাষাবাদের কাজে ফিরছেন। গোলাগুলি বন্ধ থাকার কারণে রাতে নির্ভয়ে কেটেছে। কেননা ওপারের যুদ্ধের কারণে কয়েক মাস ধরেই দ্বীপবাসীর নির্ঘুম রাত কেটেছে।
টেকনাফ-সেন্ট মার্টিন নৌ-রুটের বোট মালিক সভাপতি আবদুর রশিদ বলেন, মিয়ানমারের কারণে সাময়িকভাবে আমাদের নৌযান চলাচল বন্ধ রয়েছে। পাশাপাশি সীমান্তে আগের মতো গোলার বিকট শব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দীন বলেন, বাংলাদেশ সীমান্ত সংলগ্ন মিয়ানমারের রাখাইন এলাকা দখলে নিয়েছে আরাকান আর্মি। এ জন্যই নিরাপত্তার জন্য সীমান্তবর্তী এলাকায় মাছ শিকারে না যাওয়ার জন্য সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। তাছাড়া টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন পর্যটক যাতায়াত আগে থেকেই বন্ধ রয়েছে। তবে সেন্ট মার্টিনে নিত্য প্রয়োজনীয় মালামাল নিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া সীমান্তে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি ও কোস্ট গার্ডের টহল জোরদার রয়েছে।
নাফ নদ সীমান্ত এলাকার লবণচাষি মো. জিয়াবুল বলেন, কয়েক মাস ধরে গোলাগুলির শব্দের কারণে আমরা মাঠে কাজ করতে পারিনি। এতে আমাদের ব্যাপক লোকসান হয়েছে। তবে গত তিন দিন ধরে গুলির শব্দ পাইনি। আমরা নির্ভয়ে মাঠে কাজ করতে পারছি।
এ বিষয়ে টেকনাফ উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, সীমান্তে চরম উত্তেজনায় মাছ ধরার নৌকাগুলোকে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান করতে বলা হয়েছে। পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মাছ ধরার নৌকা মালিকরা মিয়ানমার সংলগ্ন এলাকায় মাছ শিকারে যাবে না বলে আশ্বস্ত করেছেন। তবে মিয়ানমারের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ফিশিং ট্রলারগুলো মাছ শিকারে যাবে। আপাতত সীমান্তে গোলার শব্দ বন্ধ থাকলেও কখন আবার গোলাগুলি শুরু হয় বলা মুশকিল।
বর্তমান পরিস্থতিতিতে টেকনাফ সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারের কথা জানিয়ে টেকনাফ-২ বিজিবি ব্যাটালিয়ানের ভারপ্রাপ্ত অধিনায়কের দায়িত্বে থাকা উপ-অধিনায়ক মেজর সৈয়দ ইশতিয়াক মুর্শেদ বলেন, ‘সীমান্ত নিরাপত্তায় বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণের বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে দায়িত্ব পালন করছে বিজিবি। সীমান্তের সুরক্ষা ছাড়াও চোরাচালান, মাদকদ্রব্য, অবৈধ অনুপ্রবেশ এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় সীমান্ত অপরাধ দমনে দায়িত্ব পালন করে আসছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উদ্ভুত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত এলাকায় নাফ নদীতে টহল তৎপরতা জোরদার করা হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘সীমান্তে নিছিদ্র নিরাপত্তায় দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জলে ও স্থলে টহল পরিচালনা করা হচ্ছে। এ ছাড়া সীমান্তের যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।’
এদিকে গত শনিবার থেকে মিয়ানমার থেকে পণ্যবাহী কোনো কার্গো ট্রলার ও জাহাজ টেকনাফ স্থলবন্দরে আসেনি এবং মালামাল খালাস করা কার্গো ট্রলার ও জাহাজ মিয়ানমারে ফেরত যেতে পারছে না বলে জানিয়েছেন টেকনাফ স্থল বন্দর পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান ইউনাইটেড ল্যান্ড র্পোট লিমিটেডের ব্যবস্থাপক সৈয়দ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন।
তিনি বলেন, ‘সর্বশেষ গত শুক্রবার মিয়ানমারের আকিয়াব বন্দর থেকে মাছ ভর্তি একটি কার্গো ট্রলার টেকনাফ স্থলবন্দরের জেটিতে নোঙ্গর করেছে। মালামাল নিয়ে আসা চারটি কার্গো ট্রলার বর্তমানে স্থলবন্দরের জেটিতে রয়েছে। এর মধ্যে দুইটি কার্গো ট্রলার থেকে মালামাল খালাস করা হলেও মিয়ানমারের ফেরত যেতে পারছে না।’
উল্লেখ্য, মিয়ানমারে চলমান দেশটির সামরিক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধেকালে গত রবিবার মংডুতে সামরিক জান্তার বর্ডার গার্ড পুলিশ ডিভিশন (নাখাখা-৫)-এর শেষ পোস্টটিও পুরোপুরি দখলে নেওয়ার কথা বলে এক বিবৃতি দেয় আরাকান আর্মি। এর পর থেকে নাফ নদের আরাকান জলসীমায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সব ধরনের নৌযান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। পরের দিন থেকে টেকনাফ সীমান্তে সে দেশে থেকে কোনো ধরনের গোলার বিকট শব্দ ভেসে আসেনি এপারে।