বাসস
  ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯:১৫

চিকিৎসক ও নার্স সংকটে সুনামগঞ্জ উপজেলার হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা

সুনামগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়

মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী

সুনামগঞ্জ, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪(বাসস): চিকিৎসক ও নার্স সংকটে সুনামগঞ্জ উপজেলার হাসপাতালরগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশা । হাওরের মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। চিকিৎসক ও নার্স সংকটে স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, জেলার ১২টি উপজেলা ও ৪টি পৌরসভার প্রায় ২৭ লাখ মানুষ।

জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলার ১২টি উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থাকলেও নেই তেমন জনবল। নতুন মধ্যনগর উপজেলা হলেও এখনও এ উপজেলায় নেই কোনো স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স নেই। চিকিৎসাসেবা চলে সুনামগঞ্জ ২৫০ শয্যা জেলা সদর হাসপাাতালে।

জেলার ১০টি উপজেলা ১১০জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও শূন্য রয়েছে ৫৭ জন চিকিৎসকের এবং ৩৩৯ জন নার্সের পদ থাকলেও শূন্য পদ রয়েছে ১১৫ পদ। এছাড়াও অন্যান্য জনবলের জন্য ১ হাজার ১৮৮টি পদ থাকলেও কর্মরত আছেন ৭০৬ জন। শূন্য পদ রয়েছে ৪৮২ জন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে গাইনি চিকিৎসক থাকার কথা থাকলেও জেলার মাত্র দুটি উপজেলায় কর্মরত আছেন গাইনি চিকিৎসক।

দিরাই: হাওর বেষ্টিত এ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ও আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সহ ৯ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও  কর্মরত আছেন ৪ জন। ৫ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। চিকিৎসকের শূন্য পদগুলো হচ্ছে, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা, আবাসিক মেডিকেল অফিসার, জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), জুনিয়র কনসালটেন্ট(সার্জারি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (মিডিসিন) ও ডেন্টাল সার্জন। এছাড়াও সিনিয়র স্টাফ নার্স ২৫ জনের মধ্যে ১২ জনেরই পদ শূন্য। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সটি দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ১১৭টি পদে মধ্যে ২৫টি পদ শূন্য রয়েছে। উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারীর শূন্যপদগুলো হচ্ছে মেডিকেল টেকনোলজিস্ট ডেন্টাল একজন, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (রেডিওলজি), মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) ৩টি পদের মধ্যে ২টিই শূন্য, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (এসআই), ক্যাশিয়ারের পদ শূন্য রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে।

এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মনি রানী তালুকদার বাসসকে জানান, উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার পদটি হচ্ছে প্রশাসনিক। তিনি মেডিকেল অফিসার হয়েও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করছেন। ভারপ্রাপ্ত আবাসিক মেডিকেল অফিসার দুই মাসের জন্য ঢাকায় প্রশিক্ষণে রয়েছেন। কার্যত তিনজন চিকিৎসক দিয়েই চলছে এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসাসেবা।

তিনি আরো জানান, দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পার্শবর্তী কয়েকটি উপজেলার রোগী সেবা নিতে আসেন। এগুলো হচ্ছে, সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার দিরাই উপজেলা সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর রোগী, শন্তিগঞ্জ উপজেলা, জগন্নাথপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামের রোগী এবং হবিগঞ্জ জেলার আজমিরিগঞ্জ উপজেলা, নেত্রকোনা জেলার খলিয়াজুরি উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রামগুলোর রোগীরা দিরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা নিতে আসে।

দিরাই উপজেলার সচেতন ব্যক্তি সোয়েব হাসান বাসসকে জানান, জুনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি) না থাকায় হাওর বেষ্টিত এ উপজেলা মহিলা রোগীরা পড়েছেন বিপাকে। অনেক পর্দাশীল নারী রোগীরা পুরুষ চিকিৎসক দেখাতে চান না। তাই তাদের বাধ্য হয়ে দীর্ঘ পথ মারিয়ে সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেট যেতে হয়।

তিনি আরো জানান, হাওর অধ্যুষিত এ অঞ্চলের গরিব নারী রোগীদের একমাত্র ভরসাস্থল হচ্ছে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। তাদের পক্ষে সুনামগঞ্জ কিংবা সিলেট যাওয়া অনেক ব্যয় ও কষ্ট সাধ্য বিষয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক হওয়ায় ডেলিভারি রোগীদের অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে অন্তত গাইনি চিকিৎসক পদায়ন করে এ অঞ্চলের নারীদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে দুর্ভোগ লাঘবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আহ্বান জানান সোয়েব হাসানসহ এলাকাবাসী।

শাল্লা: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ড. যশোবন্ত ভট্টাচার্য্য বাসসকে জানান, হাওর  অধ্যুষিত দুর্গম এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৩১ শয্যার স্বস্থ্য কমপ্লেক্সে। এ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১১ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন তিনজন চিকিৎসক। ৮ জন চিকিৎসকের পদই শূন্য।

শান্তিগঞ্জ: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পানা কর্মকর্তা ড. ইকবাল হোসেন বাসসকে জানান,  নতুন সৃষ্ট শন্তিগঞ্জ ৫০ শয্যা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে  ১৩ জন চিকিৎসকের পদ থাকলেও শূন্য রয়েছে ১১ জন চিকিৎসকের পদ।

বিশ্বম্ভরপুর: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ড. আব্দুল্লাহেল মারুফ ফারুকী বাসসকে জানান, এ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন চিকিৎসকের স্থলে কর্মরত আছে ২ জন এবং ৮ জন চিকিৎসকের পদই রয়েছে শূন্য।

ছাতক: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ড. রাজীব চক্রবর্তী বাসসকে জানান, ছাতক স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১০ জন চিকিৎসকের স্থলে ৫ জন কর্মরত আছে এবং ৫ জনের পদ শূন্য রয়েছে।

জামালগঞ্জ: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মহিউদ্দিন আলমগীর বাসসকে জানান, ১১ জন চিকিৎসকের স্থলে ৫ জন কর্মরত এবং ৬ জনের পদই শূন্য।

দোয়ারাবাজার: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. আবু সালেহীন খান বাসসকে জানান, ১১ জন চিকিৎসকের স্থলে কর্মরত আছেন ৩ জন এবং ৮ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে।

জগন্নাথপুর: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ড. শরিমিন আরা বাসসকে জানান, জগন্নাথপুর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১১ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন ৯ জন এবং ২ জনের পদ শূন্য রয়েছে।

তাহিরপুর: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মির্জা নিয়াদ হাসান বাসসকে জানান, তার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ১৩ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন ৩ জন এবং ১০ জনের পদ শূন্য রয়েছে।

ধর্মপাশা: উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সবির সরকার বাসসকে জানান, তার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৯ জন চিকিৎসকের মধ্যে কর্মরত আছেন ৩ জন এবং ৬ জন চিকিৎসকের পদই রয়েছে শূন্য।

সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সুনামগঞ্জ জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফজলুল করিম সাঈদ বাসসকে বলেন, সুনামগঞ্জ জেলায় ১২টি উপজেলার মধ্যে ১০টি উপজেলায় স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স রয়েছে। ১০টি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের মধ্যে মাত্র দুটি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি সার্জন রয়েছেন। বাকি ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো গাইনি চিকিৎসক নেই।

তিনি আরো বলেন, ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোনো গাইনি চিকিৎসক না থাকায় এ অঞ্চলগুলোর গরিব নারীরা চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যতদ্রুত সম্ভব জেলার এ ৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গাইনি চিকিৎসক পদায়ন করা দাবি জানান ফজলুল করিম।

সিভিল সার্জন ডা. জসিম উদ্দিন বাসসকে জানান, সুনামগঞ্জের জনবল সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নিকট প্রতিমাসেই প্রতিবেদন পাঠানো হলেও কোনো ফল পাওয়া যাচ্ছে না।