শিরোনাম
॥ হারুন আল নাসিফ॥
ঢাকা, ৩১ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : ২০২৪ সাল শেষ হয়ে গেলো। আরেকটি বছর আমাদের জীবনে নানা অভিজ্ঞতা, অর্জন ও চ্যালেঞ্জের স্মৃতি রেখে গেলো। বাংলাদেশের জন্য ২০২৪ সাল ছিল একটি টালমাটাল ও উত্তেজনাপূর্ণ বছর। রাজনীতি, অর্থনীতি, পরিবেশ এবং সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে বছরটি আমাদের অনেক শিক্ষা দিয়ে গেছে। বিশেষ করে জুলাই-আগস্ট মাসের গণ-অভ্যুত্থান এ বছরের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলোর মধ্যে অন্যতম।
জুলাই-আগস্ট গণ-অভ্যুত্থান : গণমানুষের জাগরণ
২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্ট মাস বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। বছরের মাঝামাঝি সময়ে রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে পৌঁছে যায়। নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সারাদেশে গণবিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এই সময়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী এবং রংপুরসহ দেশের বড় শহরগুলোতে লক্ষ লক্ষ মানুষ রাজপথে নেমে আসে।
জুলাই মাসের প্রথম দিকে বিক্ষোভগুলো শান্তিপূর্ণ থাকলেও, পরিস্থিতি দ্রুত অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। বিভিন্ন স্থানে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ, গ্রেপ্তার এবং কয়েকটি প্রাণহানির ঘটনা দেশজুড়ে উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তোলে।
অগস্ট মাসে আন্দোলন আরও তীব্র রূপ নেয়। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং কর্মজীবী মানুষের সহমর্মিতা আন্দোলনকে গণ-অভ্যুত্থানে রূপ দেয়। এই গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশকে গণতন্ত্রের প্রতি আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করেছে এবং প্রমাণ করেছে যে জনগণের ঐক্যই দেশের সবচেয়ে বড় শক্তি।
অর্থনীতি : চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা
২০২৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং বৈশ্বিক মন্দার চাপে ছিল। তবে পোশাকশিল্পের উন্নতি এবং নতুন রপ্তানি বাজারে প্রবেশ দেশের জন্য আশার আলো দেখিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার কয়েকটি দেশে নতুন বাণিজ্য চুক্তি বাংলাদেশকে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সহায়তা করেছে।
তবে মুদ্রাস্ফীতি এবং খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও তা পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। তবুও, দেশের অর্থনীতির ভিত্তি শক্তিশালী রাখতে সরকারের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
শিক্ষা ও প্রযুক্তির প্রসার
২০২৫ সালে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলাদেশ আরও অগ্রসর হয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নে প্রযুক্তি নির্ভর প্রকল্পগুলো আরও জোরদার হয়েছে। স্কুল-কলেজে ই-শিক্ষা কার্যক্রম সম্প্রসারিত হয়েছে, যা করোনার পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের কাছে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার প্রতি গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশ তরুণদের মধ্যে নতুন উদ্যম তৈরি করেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে প্রযুক্তির অবদান বাড়ছে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
২০২৪ সালেও বাংলাদেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করতে হয়েছে। বছরের শুরুতে ঘূর্ণিঝড় এবং আগস্টে অস্বাভাবিক বন্যা দেশের উপকূলীয় এলাকা এবং উত্তরাঞ্চলে তীব্র ক্ষয়ক্ষতি করে। তবে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সরকারের আগাম প্রস্তুতি এবং এনজিওগুলোর সমন্বিত কার্যক্রম ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। কোপ-২৯ সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব এবং আন্তর্জাতিক জলবায়ু তহবিল থেকে অর্থ সংগ্রহ উন্নয়নের জন্য বড় অর্জন ছিল।
রাজনীতি: উত্তেজনা ও সমঝোতা
২০২৪ সাল বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল। বছরের শুরুতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভক্তি এবং উত্তেজনা থাকলেও বছরের শেষে গণ-অভ্যুত্থানের ফলস্বরূপ একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার লক্ষ্যে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়েছে।
এই সমঝোতা গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের বিশ্বাসকে আরও দৃঢ় করেছে এবং প্রমাণ করেছে যে সংলাপের মাধ্যমে যে কোনো সংকটের সমাধান সম্ভব।
ক্রীড়া ও সংস্কৃতির অর্জন
২০২৪ সালে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন ছিল সাফল্যে ভরপুর। ক্রিকেটে টাইগাররা বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে পৌঁছে নতুন ইতিহাস তৈরি করেছে। ফুটবলে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ ফাইনালে পৌঁছেছে, যা দেশের ফুটবলপ্রেমীদের জন্য বড় আনন্দের বিষয়।
সংস্কৃতির দিক থেকেও বছরটি ছিল উল্লেখযোগ্য। দেশের চলচ্চিত্র, নাটক এবং সংগীত আন্তর্জাতিক মঞ্চে জায়গা করে নিয়েছে। তরুণ শিল্পীদের নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে।
সমাজ ও জনজীবন
২০২৫ সালে জনজীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ডিজিটাল সেবার প্রসারে জনগণের দৈনন্দিন কাজ সহজ হয়েছে। তবে শহুরে জীবনে যানজট এবং দূষণ সমস্যা এখনও বড় চ্যালেঞ্জ। গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট সংযোগ বাড়ানোর প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে, যা ভবিষ্যতে শহর-গ্রামের ব্যবধান কমাতে সহায়ক হবে।
শিক্ষা ও প্রত্যাশা
২০২৪ সাল আমাদের শিখিয়েছে যে ঐক্যবদ্ধভাবে যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা সম্ভব। বিশেষ করে গণ-অভ্যুত্থান প্রমাণ করেছে যে জনগণের শক্তিই দেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ।
২০২৪ আমাদের পেছনে রেখে যাচ্ছে গণতন্ত্র, উন্নয়ন এবং জনগণের সংগ্রামের নতুন একটি অধ্যায়। ২০২৫ সালে আমরা নতুন প্রত্যাশা নিয়ে একটি সুন্দর ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের দিকে এগিয়ে যাব।