দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : বাংলাদেশের মাটিতে সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনো যুদ্ধক্ষেত্র না থাকলেও কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি আজও সেই ভয়াবহ যুদ্ধের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চারপাশে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, সারি-সারি সমাধিফলক এবং শান্তির বার্তা-সব মিলিয়ে এটি শুধু একটি কবরস্থান নয়, বরং যুদ্ধের ভয়াবহতা, অমূল্য ত্যাগ ও মানবতার এক জ্ঞানগর্ভ দলিল।
১৯৩৯ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত বিশ্ববাসী অভিজ্ঞতা করেছে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ও ভয়াবহ সংঘাত-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ছিল এক জটিল যুদ্ধক্ষেত্র, বিশেষত মিয়ানমারের সীমান্ত এলাকা ছিল কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মিয়ানমারে কমনওয়েলথ সেনাদের সঙ্গে জাপানি বাহিনীর তীব্র লড়াই চলে। এই সংঘাতে প্রায় ৪৫ হাজার সৈনিক জীবন হারান। বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমারে বহু যুদ্ধ সমাধিক্ষেত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম এবং সবচেয়ে সুন্দরভাবে সংরক্ষিত হলো কুমিল্লার ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি।
ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট এলাকার পাশেই প্রায় চার একর বিস্তৃত একটি এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে এই সমাধিক্ষেত্র। সবুজ ঘাসে মোড়া জমিন, সুসজ্জিত গাছপালা, আর সমাধিফলকের সযত্ন রক্ষণাবেক্ষণ সব মিলিয়ে এটি দর্শনার্থীর মনে এক গভীর প্রভাব ফেলে। এখানে সমাহিত রয়েছে যুক্তরাজ্যের ৩৫৭ জন সৈনিক, কানাডার ১২ জন, অস্ট্রেলিয়ার ১২ জন, নিউজিল্যান্ডের চারজন, অবিভক্ত ভারতের ১৭১ জন, রোডেশিয়ার তিনজন, পূর্ব আফ্রিকার ৫৬ জন ও পশ্চিম আফ্রিকার ৮৬ জন সৈনিক। প্রথমে সংখ্যাটি ছিল ৭৩৭, কিন্তু জাপানের ২৪ জনের দেহাবশেষ স্বদেশে ফেরানোর পর বর্তমানে এখানে বিশ্রাম নিচ্ছেন ৭১৩ জন সৈনিক।
প্রতিটি সমাধিফলক যেন এক একটি জীবন্ত ইতিহাসের সাক্ষ্য। নাম, জন্ম ও মৃত্যুর তারিখ- এগুলো যুদ্ধের নির্মমতা ও মানবিক ত্যাগের এক মর্মস্পর্শী দলিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সৈনিক ছিলেন মাত্র ১৮ থেকে ১৯ বছর বয়সী, যারা জীবনের সূচনা করেই যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ হারিয়েছেন।
নরসিংদী থেকে ভ্রমণে আসা দর্শনার্থী লামিসা তাবাস্সম মীম বলেন, ‘প্রথমে ভেবেছিলাম এটি শুধু একটি ইংরেজ কবরস্থান। কিন্তু এখানে এসে আমি বুঝতে পারলাম, প্রতিটি সমাধি একটি অদেখা ইতিহাস বহন করছে।’
প্রতি বছরের নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রিতে অনুষ্ঠিত হয় স্মরণসভা। কমনওয়েলথভুক্ত দেশের প্রতিনিধি, কূটনীতিক ও স্থানীয়রা নিহত সৈনিকদের উদ্দেশে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। প্রার্থনার সুরে সমাধিক্ষেত্র এক নীরব আবেগে ভরে ওঠে। শান্তি, সহমর্মিতা ও মানবতার বার্তা চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।
ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রির দেখভাল করে কমনওয়েলথ ওয়ার গ্রেভস কমিশন (সিডব্লিউজিসি)। এই প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ কান্ট্রি অ্যাডমিনিস্ট্রেটর আব্দুর রাহিম সবুজ বলেন, ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি শুধু একটি সমাধিক্ষেত্র নয়, এটি যুদ্ধের ভয়াবহতা ও শান্তির প্রয়োজনীয়তার এক অনন্য দলিল। সারি-সারি সমাধিফলক আমাদের সতর্ক করে দেয়- যুদ্ধ কেবল ধ্বংস বয়ে আনে, শান্তিই পারে পৃথিবীকে রক্ষা করতে।
তিনি আরও বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা দলবেঁধে এখানে আসেন। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল ও কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এখানে এসে ইতিহাস শেখেন, যুদ্ধ ও শান্তি নিয়ে আলোচনা করেন। এ ধরনের সমাধিক্ষেত্র তরুণদের জন্য একটি জীবন্ত পাঠশালা। এখানে এসে তারা ইতিহাসের পাশাপাশি মানবতার গুরুত্বও উপলব্ধি করেন।’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শফিকুল আলম হেলাল বলেন, ‘ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি শুধু একটি কবরস্থান নয়, এটি ইতিহাসের সাক্ষ্য, শান্তির বার্তা এবং মানবতার শিক্ষা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের পৃথিবীকে শান্তির পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। যুদ্ধের ভয়াবহতা এড়ানোর একমাত্র উপায় হলো কূটনীতি, সংলাপ ও পারস্পরিক বোঝাপড়া।’