জুমের সোনালি ধানে ঘরে ঘরে খুশির বন্যা 

বাসস
প্রকাশ: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭:২৩
পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ে পাকা সোনালি ধান জুমিয়াদের এনে দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য। ছবি: বাসস

\ জীতেন বড়ুয়া \

খাগড়াছড়ি, ২৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : খাগড়াছড়ির পাহাড়ে পাহাড়ে এবার জুম চাষে ব্যাপক ফলন হয়েছে। প্রয়োজনীয় বৃষ্টিপাত হওয়ায় বিবর্ণ পাহাড়গুলো ফসলে ফসলে সবুজ হয়ে উঠেছে। ক’দিন পর পর থেমে থেমে বৃষ্টি আর অনুকূল আবহাওয়ার কারণে এবার জুমের আবাদ ও ফলন ভাল হয়েছে। পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ে পাকা সোনালি ধান জুমিয়াদের এনে দিয়েছে পারিবারিক স্বাচ্ছন্দ্য। ঘরে ঘরে এখন খুশির বন্যা।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও স্থানীয় জুম চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায়। পাহাড়ের জুম চাষিরা এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন। পাহাড়ের গায়ে লাগানো ধান, মরিচ, মারফা, ভুট্টাসহ নানা ফসল বেড়ে উঠছে এখন। আর ফসলের পরিচর্যায় পরিবারের ছোট থেকে বড় সকলেই সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করছে। আর দুপুরে বিশ্রামের জন্য পাহাড়ের গায়ে পাহাড়িরা তৈরি করেছে অস্থায়ী জুম ঘর। 

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় প্রায় ১ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে ৫ হাজার জুমিয়া পরিবার জুম চাষ করছে। যা গত বছর থেকে ২৬ হেক্টর বেশি। গত বছর ধান উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৫ শত ৪০ মে.টন।  এ বছর উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হয়েছে ১ হাজার ৫শত ৪৮ মে.টন।  যা গত বছর থেকে ৮ মে.টন বেশি। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জুমের আবাদ হয়েছে দীঘিনালা উপজেলায়। পার্বত্য অঞ্চলে লাঙলে চাষাবাদের জমির পরিমাণ খুবই কম। ফলে পাহাড়ীরা জীবন ধারণের একমাত্র উপায় পাহাড়ে আদিযুগের প্রথানুযায়ী জুম পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করে থাকে।

সাধারণত পৌষ-মাঘ মাসে মালিকানাধীন কিংবা পরিত্যক্ত ঘন বন-জঙ্গল, পাহাড় নির্বাচন করে জঙ্গল কাটা শুরু হয় এবং ফাল্গুন-চৈত্র মাস পর্যন্ত প্রখর রোদে শুকিয়ে আগুনে পুড়ে ছাই করা হয়। ন্যাড়া পাহাড়ে বৈশাখের প্রথম বৃষ্টিতে প্রথম বীজ ধান বপন ও পরবর্তীতে বিভিন্ন তরিতরকারির বীজ বপনসহ নানাপ্রকার ঔষধি গাছ ও সবজি রোপণ করা হয়। 

বর্তমানে জুম পদ্ধতিতে উৎপাদিত ফসলের মধ্যে রয়েছে; মারপা (শসা জাতীয়) বরবটি, শীম, বেগুন, চিকন মরিচ, ধনিয়া, কুমড়া, ঢেঁড়স, বাতিমা, কচুসহ নানা প্রকার বর্ষাকালীন সবজি। এ সমস্ত সবজি পার্বত্য অঞ্চলের প্রতিটি হাটবাজারে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যাচ্ছে। হাটের দিনে বিভিন্ন জেলার কাঁচামালের ব্যবসায়ীরা পাইকারি হারে তা ক্রয় করে ট্রাক ভর্তি করে চালান করছে সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে। জুম তরকারির মধ্যে জুম মিষ্টি কুমড়া ও সাদা কুমড়া সুস্বাদু বলে সব এলাকায় প্রিয়। জুম উৎপাদিত তরিতরকারিগুলো তুলনামূলকভাবে অন্যান্য তরকারির চেয়ে কম মূল্য এবং ক্রেতার সংখ্যা বেশি বলে জানা গেছে। এবার এই দেশের অন্যান্য জেলায় তরিতরকারির দাম বেশি হওয়ায় জুম চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসল পাইকারি ব্যবসায়ীদের কাছে বেশ ভাল দামে বিক্রি করতে পারছে। অন্যান্য বছর যেখানে জুম চাষিরা প্রতি কেজি মারফা (শসা জাতীয়) ফল ২০ টাকা থেকে ২২ টাকা দামে বিক্রি করতেন। বর্তমানে স্থানীয় বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা দামে। তরিতরকারির ন্যায্য মূল্য পেয়ে চাষিরা আনন্দিত।

জুমের ধানের পাশাপাশি চাষ করা হয়েছে, মিষ্টি কুমড়া, চাল কুমড়া, লাউ, কইডা ঝিঙা, মারফা, বরবটি, চিনাল ও কলাসহ হরেক রকমের শাকসবজি। এছাড়াও রয়েছে, কাউন, ভুট্টা, আদা, হলুদ, মরিচ ও তিলসহ নানা প্রজাতির মশলা জাতীয় ফসল। 

জুম চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, স্থানীয় হাট-বাজারে এসব শাক-সবজি এবং মসলাজাতীয় ফসলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এতে তাদের প্রচুর লাভ হচ্ছে।  শুধু তাই নয় বর্তমানে উপজেলার হাট-বাজারগুলোতে স্থানীয়দের বেশির ভাগ সবজির চাহিদা পুরণ করছে জুম চাষিরা। তাছাড়াও পাহাড়ের হাট-বাজারে সারা বছরই  জুমের কোনো না কোনো ফসল পাওয়া। তারমধ্যে কলা, আদা, হলুদ ও মরিচ অন্যতম।

প্রতি বছর দিঘীনালা উপজেলার মেরুং, কবাখালী, বোয়ালখালী ও দীঘিনালা ইউনিয়নের দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জুমচাষ করা হলেও সবচেয়ে বেশি জুমচাষ করা হয় বাবুছড়া ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী দুর্গম নাড়াইছড়ি এলাকায়।  এবছরও ব্যাপক হারে জুমচাষ করেছে সীমান্তবর্তী দুর্গম এই জনপদের মানুষ। যেখানে এখনো কোনো সড়ক যোগাযোগ গড়ে ওঠেনি। চাষিরা জানান, ফলন ভালো হলেও এ অঞ্চলের সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকায় জুমে উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না তারা। 

দুর্গম এই পাহাড়ি এলাকার জুম চাষি তুক্যে চাকমা, সুভাষ চাকমা ও চন্দ্রশুভ চাকমা জানান, ফলন ভালো না হলে তাদের অনাহার অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়। এবার তারা খুশী । সনাতন পদ্ধতির এই জুম চাষের ওপর নির্ভর করেই ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ এবং সংসার চলে বলে জানান তারা। 

সীমান্তবর্তী দুর্গম এই  পাহাড়ী এলাকার কয়েকটি জুম ঘুরে দেখার সময় নাড়াইছড়িমুখ নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান  শিক্ষক অন্তহীন চাকমা জানান, জুমে হরেক রকম শাক-সবজি ও মসলাজাতীয় ফসলের পাশাপাশি এ বছর গেলং, বাদেয়ি এবং রেংগুই জাতের ধানের ফলন ভালো হয়েছে। ফলন ভালো হওয়ায় জুমচাষিরা খুশি হলেও একমাত্র সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা না থাকার কারণে তারা ন্যায্যমুল্য পাচ্ছেন না।

বাবুছড়া ইউপি চেয়ারম্যান গগন বিকাশ চাকমা জানান, চাষাবাদযোগ্য সমতলে কোনো জায়গা জমি না থাকায় সীমান্তবর্তী দুর্গম এই পাহাড়ি এলাকার বেশির ভাগ মানুষ জুম চাষের ওপর নির্ভরশীল। অনেকটা প্রকৃতি নির্ভর এই চাষাবাদই তাদের একমাত্র ভরসা। এ বছর ফলন ভালো হওয়ায় জুমিয়া পরিবারগুলো খুশি বলে জানান তিনি।

জেলা সদরের ৯ মাইল এলাকার জুম চাষি হরি ত্রিপুরা জানান, এবার প্রথম থেকে আবহাওয়া ছিল অনুকূলে। চৈত্র-বৈশাখ মাসে জুমের গুল্ম লতা পুড়ে ফেলার জন্য ছিল প্রখর রোদ। জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় মাসে ধানসহ বিভিন্ন ফলের চারা গজিয়ে ওঠার জন্য পর্যাপ্ত বৃষ্টি ছিল। ব্যাপক হারে ভূমি ধসের আশঙ্কা থাকলেও ভূমি ধস কম হওয়ায় কৃষকরা মারাত্মক ক্ষতি থেকে বেঁচে গেছে। ফলে এবার জুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। 

খাগড়াছড়ি শহরের আলুটিলা, দীঘিনালা সড়কের বিভিন্ন স্থানে জুমে উৎপাদিত পাকা ধান কাটা শুরু হয়েছে। বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে জুমে নতুন জাতের ধান বপন ও পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনষ্টিউট আউষ মৌসুমের বিরি- ২৪, বিরি- ২৬, বিরি- ২৭ সহ গবেষণায় পরীক্ষাধীন দুটি জাতের ধান জুমে পরীক্ষামূলকভাবে খাগড়াছড়িতে আবাদ করেছে।

কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক মো. বশিরুল আলম বলেন, প্রদর্শনী প্লটে জুমের আবাদ ভাল হয়েছে। চারটি জাতের মধ্যে বিরি- ২৪ ও বিরি- ২৭ এর ফলন সবচেয়ে বেশি হয়েছে।  তিনি আরো জানান, আগামীতে খাগড়াছড়িতে জুমচাষিদেরও সরকারি প্রণোদনার আওতায় আনা হবে।  

খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট-এর বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আব্দুল্লা আল মালেক বাসসকে বলেন, বর্তমানে আধুনিক পদ্ধতিতে জুম চাষের কারণে এখন ভালো ফলন পাচ্ছে কৃষক। কারণ দিনে দিনে পাহাড়ের মাটি ক্ষয় ও উর্বরতা কমে যাওয়ার কারণে জুম পাহাড়ে বাড়ছে সারের ব্যবহার। আগে এক পাহাড়ে দীর্ঘ বছর পরপর জুম চাষ হলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং জুম পাহাড়ের সংখ্যা কমে যাওয়ায় এখন একই পাহাড়ে প্রতি বছর জুম চাষ করা হচ্ছে। 

তিনি জানান, জুম চাষের আধুনিক পদ্ধতি পালটে দিয়েছে চাষাবাদের ধরন। এই পদ্ধতিতে পরিমিত সার ব্যবহার করে প্রতি বছর একই জমিতে বার বার ফসল উৎপাদন করতে পারবে। তবে খাগড়াছড়িতে জুমে উৎপাদন বাড়াতে সনাতনী জুমের পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতিতে জুম চাষ করার উপর জোর দিয়েছে কৃষি বিজ্ঞানীরা। জুমের ফলন বাড়াতে গবেষণা করছে পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র। আধুনিক পদ্ধতিতে পরিবেশবান্ধব জুম চাষ করলে জুমে উৎপাদন বাড়বে।

জুম চাষের উপর নেতিবাচক ধারণা থাকলেও পার্বত্য অঞ্চলের বড় ছোট প্রায় ১৪ টি বিভিন্ন ভাষাভাষীর ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ সাধারণত এই জুম চাষ করেই যুগ যুগ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। এছাড়াও পাহাড়ি এলাকায় জুমে উৎপাদিত প্রত্যেকটি ফসল সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর। 

পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় নেতা ও আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য গৌতম কুমার চাক্মার ১৯৮৮ সালে লেখা এক নিবন্ধে উল্লেখ করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১ লাখ পরিবার জুম চাষ করে। অপরদিকে ২০০১ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায় যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের ৫টি প্রধান জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুরং ৮৪.০৪ ত্রিপুরা ৫৪.০৮, মারমা ৪২.৩, চাক্মা ২২.০৭, এবং ১.০৬% বাঙালি জুম চাষ করেন। চাক্মা সম্প্রদায় জুম, ত্রিপুরা ভাষায় ছুগ এবং মারমা ভাষায় ইয়া নামে পাহাড়ে জুম চাষ হয়ে থাকে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের দুই নেতাকে গ্রেফতার করেছে সিএমপি
পাকিস্তান-ভারতের ১১তম ফাইনাল
এশিয়া কাপের রোড টু ফাইনাল
মালয়েশিয়ায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণ
গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ৫১৪ জন হাসপাতালে ভর্তি
ওয়্যারহাউজ ইন্সপেক্টর খন্দকার জান্নাতুল নাঈমের জানাজা অনুষ্ঠিত
দুর্গাপূজা উপলক্ষে ৬ দিন বন্ধ থাকবে ভোমরা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম
৭ম ক্যারম ওয়ার্ল্ড কাপের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প শুরু
সিলেট সীমান্তে প্রায় দেড় কোটি টাকা মূল্যের চোরাই পণ্য জব্দ, আটক এক
জাবির আবৃত্তি সংগঠন ধ্বনি’র নতুন কার্যনির্বাহী কমিটি
১০