ঢাকা, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : মার্জিয়া নবম শ্রেণির ছাত্রী। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। মা গার্মেন্টস কারখানায় কাজ করে আর বাবা সিএনজি চালক। মিরপুরে আটকে পড়া পাকিস্তানিদের ক্যাম্পের পাশের কোয়ার্টারে দুই রুমের বাসায় ভাড়া থাকেন তারা। স্কুলে মার্জিয়ার সহপাঠী বন্ধুদের অনেকের অবস্থা ওদের চেয়ে ভালো। ওরা স্কুল শেষে তিনটা কোচিং-এ পড়তে যায়। মার্জিয়ার মা-বাবা একটা কোচিং-এ পড়ার খরচ দিতে পারেন। স্কুলের শিক্ষকদের কাছে না পড়ায় সব বিষয়ে পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল আসেনা। এসবের জন্যে মন খারাপ থাকে তার। স্কুলের পিকনিকে, বার্ষিক উৎসবে, বন্ধুদের জন্মদিনে অন্যরা দামী পোশাক পরে, দামী উপহার দেয়। ওদের হাতে থাকে নতুন নতুন মডেলের দামি মোবাইল ফোন। মার্জিয়া মায়ের কাছে অনেক চেয়ে-চিন্তে একটা চোরাই ফোন নিতে পেরেছে। মন খারাপ হয় এসব দেখে। ফলে ধীরে ধীরে বন্ধুদের সাথে অনুষ্ঠানে যাওয়া কমিয়ে দেয় সে। স্কুল আর কোচিং ছাড়া আর কোথাও বের হয় না। সারাদিন বাসায় একা থাকে। তাকে ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে না কেউ। রাতে একা জেগে জেগে ব্রাউজিং করে, ফেসবুকে দুই-তিনটা ছেলের সাথে চ্যাটিং হয়। বুঝতে পারে না কী করবে, কী করবে না। পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় দিনের কাজে, পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারে না মার্জিয়া। ধীরে ধীরে খাওয়া-দাওয়ায় মনোযোগ কমে, রোগা আর দুর্বল হতে শুরু করে সে। মা-বাবা জীবন-জীবিকার নিশ্চয়তা খুঁজছে শহরের ভিড়ে। মার্জিয়ার দিকে আলাদা করে নজর দেয়ার সময় তাদের থাকে না।
মার্জিয়ার গল্পটি সাম্প্রতিক সময়ে যেকোনো নগরের যেকোনো শ্রেণির পরিবারের সাথে মিলে যায়। যেখানে বয়োঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়েরা নানা কারণে পরিবার ও সমাজের অভিভাবকত্ব থেকে দূরে চলে যায়। তাদের ভাবনা-চিন্তা একাকীত্ব কারো সাথে ভাগ করে নিতে পারে না। তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারে তারা দিশাহীন। ফলশ্রুতিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাজার মুখের ভিড় থাকলেও প্রকৃত বন্ধুর সান্নিধ্যের অভাবে তারা নিঃসঙ্গ। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক অবস্থান এক না হওয়ায় বন্ধুদের সাথে দূরত্ব তৈরি হয়। তাদের অনেকের প্রত্যাশাই পূরণ হয় না। অনেকের উচ্চাকাঙ্ক্ষী মন হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে সহজেই। শিশুদের বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে নানারকম প্রতিবন্ধকতার ভেতর মানসিক স্বাস্থ্যের ক্রম অবনতি আশংকাজনক হারে বাড়ছে। এসবের মধ্যে অন্যতম হলো অবসাদ বা বিষাদগ্রস্ততা (ডিপ্রেশন)।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ওয়ার্ল্ড হেল্থ অর্গানাইজেশন) জরিপ অনুযায়ী, পৃথিবীর জনসংখ্যার ৫.৭% শতাংশ মানুষ বিষণ্নতার শিকার। মোট জনসংখ্যার ৩৩২ মিলিয়ন মানুষ যুদ্ধ করছে এই মানসিক ব্যাধির সাথে। এদের বেশিরভাগ নারী। জরিপে দেখা যায়, নারীরা (৫.১%) পুরুষের চেয়ে (৩.৬%) বেশি ভুগছে বিষণ্নতায়। এদের মধ্যে কেবল পূর্ণবয়স্করাই নয়, রয়েছে বয়োঃসন্ধিকালীন কিশোর-কিশোরী বা তরুণ শিক্ষার্থীরাও। বিষণ্নতায় ভোগা শিশুরা শারীরিক ও মানসিক দিক থেকে দুর্বল হয়ে বেড়ে ওঠে। যে বয়সে যতটা দক্ষতা অর্জন করে বিকশিত হয়ে ওঠার কথা সেটা তারা হতে পারে না। ফলে জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়ার বদলে তারা ক্রমাগত পিছিয়ে যায়, হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে এমন কি আত্মহননের দিকে নিজেদের ঠেলে দেয়।
বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান এই মানসিক সমস্যার প্রধান কারণগুলোকে চিহ্নিত করে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়— অর্থনৈতিক কারণ, সামাজিক কারণ, সাংস্কৃতিক কারণ, পারিবারিক কারণ, সতীর্থদের চাপ, রাজনৈতিক কারণ ইত্যাদি। দারিদ্র্য এবং বেকারত্ব, প্রিয়জনের মৃত্যু বা সম্পর্ক ভেঙে যাওয়া, শারীরিক অসুস্থতা, নেশায় আসক্তি, কোনো ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে সামাজিক তিরস্কার, ভৌগোলিক সীমাবদ্ধতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, সতীর্থদের সাথে মিশতে না পারা এবং তিরস্কারের (বুলিং) শিকার হওয়া এবং বয়সজনিত অসুস্থতা ও ঝুঁকির কারণে মানুষ বিষণ্নতায় ভোগে। এ প্রসঙ্গে আরও একটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ হলো গ্রাম বা মফস্বল শহরের চেয়ে বড় বড় নগরীর বাসিন্দারা তুলনামূলকভাবে বিষণ্নতায় ভুগছে বেশি। যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীতে অবিশ্বাস, অনিশ্চয়তা এবং সহিংসতার ভেতর দিয়ে যেতে যেতে মানুষ হতাশায় আক্রান্ত হচ্ছে। কাজেই অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়াটা ভয়ানকভাবে স্বাভাবিক চেহারা নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা অনুযায়ী, বাংলাদেশে বিষণ্নতার হার শতকরা ৪.১% ভাগ। ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমীক্ষা মতে, বাংলাদেশে পূর্ণবয়স্কদের মাঝে ৬.৭% মানুষ বিষণ্নতার শিকার। অর্থ্যাৎ এই বিষয়টি পরিষ্কার যে সমস্যাটি ক্রমবর্ধমান। আরও আশংকার কথা হলো, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি স্কুলগামী বয়োঃসন্ধিকালীন ছেলে-মেয়েরা এই মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ অনুযায়ী বিশেষ করে অনুচ্ছেদ ২৭-এ উল্লেখিত শিশুদের শারীরিক, মানসিক, আত্মিক, নৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের জন্যে পর্যাপ্ত জীবনমানের অধিকারকে স্বীকৃতি দেয়ার কথাকে গুরুত্ব দিয়ে এই বিষয় নিয়ে নানান সচেতনতামূলক কর্মসূচী গ্রহণ করা এখন সময়ের দাবী।