বাগেরহাটের স্থানীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে আখ চাষ

বাসস
প্রকাশ: ১৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৬:৫৩
অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে আখ চাষ। ছবি : বাসস

‎আজাদ রুহুল আমিন

বাগেরহাট, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫(বাসস) : এ জেলার আখের খ্যাতি বহুদিনের। একসময়ে জেলার সর্বত্র ব্যাপকহারে আখ চাষ হতো। জেলার বিভিন্ন গ্রামে ঘোড়ার গাইন আর মহিলারা আখের রস সংগ্রহে ব্যস্ত সময় পার করতেন। বড় বড় টিনের তৈরি তাফালে (বড় কড়াই) চুলায় আখের রস জ্বালাতেন।  সেই রস রাত জেগে গৃহিণীরা গুড় তৈরি করতেন। গুড়ের ঘ্রাণে স্কুলগামি শিক্ষার্থী, এলাকার তরুণ-তরুণীরা তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় একটু থমকে দাঁড়াতো। গৃহস্থরাও তাদের আখের গুড় দিয়ে আপ্যায়ন করতো। এভাবেই এই গুড় সারাদেশে প্রসিদ্ধি লাভ করে। 

স্থানীয় বিয়ে, মুসলমানি, মিলাদ ও দোয়ার অনুষ্ঠানে এখানকার আখের গুড় দিয়ে রান্না করা পায়েস বেশ উপাদেয় হিসেবে পরিচিত। চারিদিকে এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়তো। জেলার কচুয়া উপজেলার বাসিন্দারা রান্না করা মাছ বা তরকারি না থাকলে আখের গুড় দিয়ে ভাত খাওয়ার প্রচলন ছিল। এমনকি মাঠে কৃষকের সকালের নাস্তা পান্তা ভাতে এই গুড়ই ছিলো প্রধান উপাদান।

বাগেরহাটের কচুপট্টি, তালেশ্বর বাজার ও বাধাল বাজারে একসময় গুড়ের হাট বসতো। কিন্তু ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়ায় ধীরে ধীরে অনেক নদী ও খালবিলের পানি লবণাক্ত হয়ে পড়ায় আগের মতো আখ চাষ হয় না। 

সম্প্রতি খাল ও নদী খনন এবং অতি বৃষ্টিতে জমির মাটিতে লবণাক্ততা কমে যাওয়ায় জমির মালিকরা নতুন করে আখ চাষে আগ্রহী হয়েছেন । অধিকাংশ জমির মালিক আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে আখ চাষকে অর্থনীতির বড় খাত হিসেবে দেখছেন। এলাকার শিক্ষিত বেকার যুবকদের মধ্যেও আখ চাষে আগ্রহ বাড়ছে।  

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় চলতি বছর ২৯৬ হেক্টর জমিতে আখের আবাদ হয়েছে। চলতি অর্থ বছরে আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১২২৬৫ মেট্রিক টন। এখন পর্যন্ত ১০ শতাংশ আখের কর্তন সম্পন্ন হয়েছে। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে বলে আশা করছেন স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা ও আখ চাষিরা।
সূত্র জানায়, বাগেরহাট সদর উপজেলায় ৫ হেক্টর, মোল্লাহাট উপজেলায় ৮০ হেক্টর, রামপাল উপজেলায় ১ হেক্টর, ফকিরহাট উপজেলায় ২০ হেক্টর, কচুয়া উপজেলায় ৯৬ হেক্টর, মোরেলগঞ্জ উপজেলায় ৬০ হেক্টর, শরণখোলা উপজেলায় ৩০ হেক্টর এবং চিতলমারী উপজেলায় ৪ হেক্টর জমিতে আখের চাষ করা হয়েছে। 

বাগেরহাটের কচুয়ার আখ চাষি নাজমুল শেখ (৪৪) প্রায় ২৫ বছর ধরে আখ চাষের সাথে জড়িত। চলতি বছর ২ একর জমিতে আখ চাষে খরচ হয়েছে ২ লাখ টাকা। এ মৌসুমেই তিনি ৪ লাখ টাকার আখ বিক্রি করেছেন।

আখ চাষি মুকুল শেখ (৪৫) জানান, কার্তিক মাস থেকে জমিতে আখের চারা রোপণ করে ১০ মাস পর্যন্ত ফলনের অপেক্ষা করতে হয়। এতে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়। দৈনিক একজন শ্রমিকের মজুরি ৮০০ টাকা। 

তিনি বলেন, আখ চাষিদের জন্য সরকারি প্রণোদনা নেই। এ কারণে তারা  কৃষি ঋণ, সার বা বীজ কোনোটাই পাননা। এদিকে আখ চাষের জন্য জমি উপযোগী করতে প্রায় সবরকমের সার ব্যবহার করতে হয়। তিনি এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সুদৃষ্টি কামনা করেন। 

জেলার আখ চাষি মিজানুর রহমান (৪১) ২০ বছর ধরে আখ চাষ করে আসছেন। চলতি মৌসুমে  ১ একর জমিতে ৮০ হাজার টাকা খরচ করে আখ চাষ করেছিলেন। সেই আখ বিক্রি করেছেন ২ লাখ টাকায় । তিনি জানান, ব্যাংক থেকে ঋণ পেলে আখ চাষে জমির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি করতে পারতেন। কিন্তু কোথাও কোনো আর্থিক সহায়তা মেলেনি।
‎বাগেরহাট সদর উপজেলার আখ চাষি হুমায়ুন কবির (৩৫)বাসসকে বলেন, একবার চারা ক্রয় করে জমিতে রোপণ করলে যতদিন আখ চাষ করতে মন চাইবে তাকে আর চারা কিনতে হবে না। ক্ষেতে যে আখ উৎপাদন হবে, সেখান থেকেই আখের চারা রেখে বাকিটা বিক্রি করে অধিক লাভবান হওয়া যায়। আখের পাতা গবাদি পশুর খাদ্য হিসেবে বিক্রি করেও আখ চাষিরা লাভবান হচ্ছেন। 

জানা যায়, এই জনপদে স্থানীয় আখের ব্যাপক কদর রয়েছে। অধিকাংশই তুরফিন (নরম জাতের) আখ বলে যে কোনো বয়সের মানুষ এটা চিবিয়ে খেতে পারে। এটি সহজলভ্য ও সুস্বাদু হওয়ায় বেশি দাম দিয়েও কিনতে দেখা যায়। এখানকার আখের রস খুব মিষ্টি। জন্ডিস রোগে আক্রান্ত রোগীর জন্য আখের রস মহৌষধ হিসেবে কাজ করে বলে স্থানীয়দের বিশ্বাস। জন্ডিসের প্রতিষেধক হিসেবে বাগেরহাট শহরে ও হাট বাজারে মিনি মেশিনে মাড়াই করা আখের রস খেতে দেখা যায় নারী,পুরুষ, শিশু ও বয়বৃদ্ধকে। 

বাগেরহাটের সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. অনুপ কুমার বিশ্বাস বলেন, আখের রস জন্ডিসের রোগীদের জন্য খুব উপকারী।  

আখ চাষি রফিকুল ইসলাম (৪০) ১৫ বছর ধরে কচুয়ার নিজ গ্রাম ফুলতলায় আখ চাষ করে আসছেন। চলতি বছরে ১২ লাখ টাকা খরচ করে ৬ একর জমিতে আখ চাষ করে তা ১৮ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। এবছর তার ৬ লাখ টাকা লাভ হয়েছে।

তিনি বলেন, আখ চাষের জন্য সরকারি কোনো সহযোগিতা না পেলেও আখের ছত্রাক সংক্রমণের বিষয়ে স্থানীয় মাঠ পর্যায়ের সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মিজানুর রহমানকে জানালে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। তার পরামর্শেই আমার ক্ষেতের আখ ভালো হয়েছে এবং বেশি দামে বিক্রি করেছি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ২১ জন গ্রেফতার
‘আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আনসার সদস্যদের কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে’
পাঁচটি শীর্ষ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিপিআই'র সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লালন উৎসব ও লালন মেলা উদযাপন  
শাহজালাল বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডে দায়িত্ব পালনকালে ২৫ আনসার সদস্য আহত
ব্রাজিলে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১৫
শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় জামায়াতের আমিরের উদ্বেগ
১৫ ফিলিস্তিনির মরদেহ ফেরত পাঠাল ইসরাইল
থাইল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অভিজিৎকে রক্ষণশীল দলের নেতা হিসেবে পুনর্বহাল
বিএমইউতে ‘ইসলামী চিকিৎসা শিক্ষার বিবর্তন ও নৈতিক অনুশীলন’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত
১০