বাসস
  ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ০৯:৫৬
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৩, ১১:১১

কাশিয়ানীর হাইশুর বৃদ্ধাশ্রম জাতীয় মানব কল্যাাণ পদকে ভূষিত

॥ মনোজ কুমার সাহা ॥
টুঙ্গিপাড়া (গোপালগঞ্জ), ২৩ জানুয়ারি, ২০২৩ (বাসস) : গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার রাজপাট ইউনিয়নের হাইশুর গ্রাম। এখানেই ব্যক্তি উদ্যোগ গড়ে উঠেছে একটি বৃদ্ধাশ্রম। এ বৃদ্ধাশ্রমটি এখন অসহায় প্রবীণদের নিরাপদ ঠিকানা। প্রতিষ্ঠানটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবর্তিত জাতীয় মানব কল্যাণ পদকে ভূষিত হয়েছে। চলতি বছর জাতীয় সমাজ সেবা দিবসে সমাজ কল্যাণমন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ  প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা আশুতোষ বিশ্বাসের হাতে এ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ মানব কল্যাণ পদক, নগদ ২ লাখ টাকা ও সনদপত্র তুলে দেন ।  গোপালগঞ্জ, নোয়াখালী, পটুয়াখালী, খুলনা, যশোর, গাজীপুর, বরগুনা জেলার ২৪ জন অসহায় প্রবীণের আশ্রয় স্থল এ বৃদ্ধাশ্রম। মাদার তেরেসার আনুসারী হাইশুর গ্রামের মানবিক হৃদয়ের অধিকারী আশুতোষ বিশ্বাস বিশ্ব মানব সেবা সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন । এ সংঘের মাধ্যমে তিনি মানব সেবা করে আসছিলেন। ১৯৯৬ সালে ওই সংগঠনের আওতায় তার বৃদ্ধাশ্রমটি যাত্রা শুরু করে । ওই বছর মুকসুদপুর উপজেলার চান্দা বিলে ফুলমতি বালা (৬৭) নামে এক বৃদ্ধাকে পুত্র ও পুত্রবধূরা মারপিট করে রক্তাক্ত অবস্থায় বিলের মধ্যে ফেলে রেখে যায়। ওই প্রবীণ নারীকে আশুতোষ উদ্ধার করে হাইশুর গ্রামে নিয়ে আসনে।তাকে দিয়েই তিনি বৃদ্ধাশ্রমের কার্যক্রম শুরু করেন ।১৯৯৭ সালে ফুলমতি বালা পরলোক গমন করেন। তার বৃদ্ধাশ্রমে এ পর্যন্ত ৫৬ জন আশ্রয় নিয়েছে। এরমধ্যে ৩২ জন মৃত্যু বরণ করেছে।এখন জীবিত রয়েছেন ২৪ জন প্রবীণ। বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই আশুতোষের স্ত্রী সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মনিকা রানী বোস চাকরির উপার্জিত অর্থ ও শ্রম দিয়ে সহযোগিতা করে আসছেন। এ দম্পত্তির পরম মমতায় বৃদ্ধাশ্রমটি অসহায় প্রবীণদের নির্ভরতার জায়গায় পরিণত হয়েছে।
বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি আশুতোষ বিশ্বাস বলেন, খুব ছোটবেলা আমার মা হরিদাসী বিশ্বাস মৃত্যু বরণ করেন। ৪ বছর বয়সে বাবা ঠাকুর নকুল বিশ্বাস মারা যান। মায়ের স্মৃতি আমরা মনে নেই। বাবার কথা সামান্য মনে আছে। বড় ও ছোট চাচির কোলে বড় হয়েছি। তাদের বুকের দুধ পান করেছি। চরম দারিদ্রতার মধ্যে পাড়াশোনা করেছি। বরিশাল বিএম কলেজে থেকে বাংলায় এমএ ডিগ্রি লাভ করেছি। ছাত্র জীবনেই মাদার তেরেসাকে অনুসরণ করে চলতে শুরু করি। তাই আর্ত মানবতার সেবায় আত্মনিয়োগ ব্রতী হই। ফুলমতি বালাকে পুত্র ও পুত্রবধূরা মারপিট করে মুকসুদপুর উপজেলার চান্দা বিলে ফেলে রেখে যায়। তার রক্তাক্ত শরীর দেখে আমার মনে মমত্মবোধ জাগ্রত হয়। মা-বাবা বেঁচে থাকলে তাদের সেবা করতে হত। সেই চিন্তা থেকেই ফুলমতিকে মা মনে করেই বাড়িতে নিয়ে আসি।স্ত্রীর চাকরির টাকা দিয়ে ফুলমতিকে নিয়ে শুরু করি বৃদ্ধাশ্রম।বিভিন্ন জায়গা থেকে খাবার, সবজি, ফল সংগ্রহ করে এখনো চালিয়ে যাচ্ছি বৃদ্ধাশ্রমটি। এ বৃদ্ধাশ্রমে বিগত ২৬ বছরে সরকার, বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সহযোগিতা করে আসছে। এ কারণেই প্রতিষ্ঠানটি এ পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়েছে। বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠার আগেই বিশ্ব মানব সেবা সংঘ প্রতিষ্ঠা করে মানব সেবা করে আসছিলাম। এ কাজে আমার স্ত্রী অর্থ ও শ্রম দিয়ে সহায়তা করছেন। তাঁর প্রেরণায়  আমি এ কাজ চালিয়ে যেতে পারছি। এ কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ সরকারের  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবর্তিত মানব কল্যাণ পদক আমরা পেয়েছি।এটি আমাদের কাজের স্বীকৃতি।আমি স্বীকৃতি বা প্রচারের জন্য কাজ করি না। প্রবীণদের প্রতিদায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমি এ কাজ করি। যতদিন দেহে প্রাণ আছে,ততদিন আমি এ কাজ করে যাব।
হাইশুর বৃদ্ধাশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা আশুতোষ বিশ্বাসের স্ত্রী স্কুল শিক্ষক মনিকা রানী বোস বলেন, আর্ত মানবতার সেবায় আমাদের এ কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।আমর স্বামী এটি শুরু করেছে। আমি আজীবন অসহায় প্রবীণদের সেবা করে যাব।এ জন্য দেশ বাসীর সহযোগিতা চাই।
বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা মৌসুমী বেগম বলেন,প্রথম জীবনেই স্বামী আমাকে ত্যাগ করে চলে যায় । আমার কোন সন্তান নেই। মাঝ বয়সে নোয়াখালী থেকে  গোপালগঞ্জ শহরে চলে আসি। শহরের বাড়ি বাড়ি ঝিয়ের কাজ করতাম। কাজ করতে পারি না। তাই ৪ বছর আগে গোপালগঞ্জ সদরের লতিফপুর ইউপির জাফর হোসেন কালু চেয়ারম্যানের বোন আমাকে এ বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গেছে। এখানে বেশ ভালো আছি। আশুতোষ-মানিকা পরম স্নেহে আমাকে লালন-পালন করে। অসুস্থ্ হলে চিকিৎসা করায়। তাদের সেবায় সুস্থ্ আছি। আমর মত অন্যরাও এখানে সুন্দর জীবন কাটাচ্ছে। এ বৃদ্ধাশ্রম থাকলে আমাদের মতো অসহায় মানুষের কোন কষ্ট হবে না। তাই এ বৃদ্ধাশ্রম টিকিয়ে রাখতে সবার প্রতি অনুরোধ করছি।  
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব আলী খান বলেন, বৃদ্ধাশ্রম প্রতিষ্ঠা করে ২৬ বছর ধরে আশুতোষ বিশ্বাস ও মনিকা রানী বোস দম্পতি আর্ত মানবতার সেবা করে আসছেন। এ বৃদ্ধাশ্রমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের অসহায় ও দুস্থ’ প্রবীণরা আশ্রয় নিয়েছেন। এ দম্পতি পরম মমতায় বৃদ্ধাদের দেখভাল করেন । তারা বৃদ্ধাশ্রমটি প্রতিষ্ঠা ও অসহায় প্রবীণদেন এখানে রেখে সেবা প্রদান করে সুনাম অর্জন করেছেন ।আমি তাদের এ মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। আমি প্রতি বছর এ বৃদ্ধাশ্রমে ২ মাসের মানবিক খাদ্য সহায়তার পাশাপাশি বিস্কুট, কেক, চিড়া, মুড়ি, চিনি, চা, ফল,মিষ্টি, শীতবস্ত্র,কাপড়,ম্যাক্সি, লুঙ্গি, গামছা সহ বিভিন্ন সামগ্রী প্রদান করি। তাই এ বৃদ্ধাশ্রমটি বাঁচিয়ে রাখতে আমার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
হাইশুর গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত স্কুল শিক্ষক রণধীর ব্শ্বিাস বলেন, বৃদ্ধাশ্রম করে আশুতোষ ও তার স্ত্রী ২৬ বছর ধরে আর্ত মানবতার সেবা করে আসছেন।এটি এত সহজ কাজ নয়। তারা এ মমতাময়ী ও মানবিক কাজ করে এলাকায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ।তাদের কাজ আমাদের এলাকায় ব্যাপক প্রশংসা কুড়াচ্ছে। আশুতোষ দরিদ্র পরিবারের সন্তান। নিজের কোন সম্পদ নেই। স্ত্রীর অর্থ দিয়ে তিনি এটি শুরু করেন। অন্যের কাছ থেকে টাকা পয়সা, ধান, চাল, সবজি, মাছ এনে আশ্রম চালিয়ে যাচ্ছেন । তার মহৎ কাজকে আমি স্যালুট জানাই।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোঃ হারুন অর রশীদ বলেন, আর্ত মানবতার সেবা একটি মহৎ কাজ। আমাদের দপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন নিয়ে আশুতোষ এ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আমরা তাকে সব সময় সহযোগিতা করে আসছি। মানব কল্যাণ পদকের জন্য আশুতোষ বিশ্বাসের বৃদ্ধাশ্রমটিকে আমরা মনোনীত করি। গত ২ জানুয়ারি জাতীয় সমাজসেবা দিবসে বৃদ্ধাশ্রমটি সরকার প্রধান শেখ হাসিনা প্রবর্তিত মানব কল্যাণ পদক পেয়েছে। এটি এ জেলার জন্য অত্যন্ত গর্বের ও আনন্দের। আমরা এ মহৎ প্রতিষ্ঠানটির জন্য সর্বদা নিবেদিত থাকব ।