বাসস
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০৯:৩৬

দেশের হাওর অঞ্চলে এবার সরিষা চাষে বিপ্লব : আবাদ বেড়েছে ৮ শতাংশ

॥ মো.শফিকুল ইসলাম ॥
ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ (বাসস): সবুজের মাঝে হলুদের ছাপ, দেখলে মনে হয় প্রকৃতি আজ হলুদ শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আছে। হাওর অঞ্চলের দিগন্ত জুড়ে সরিষা মাঠের মধ্য দিয়ে উঁকিমারে রক্তিম সূর্য। হলুদে ছেয়ে গেছে হাওরের মাঠঘাট। মাঠভরা হলুদ ফুল দেখে এবার ভালো ফলনের স্বপ্ন দেখছেন হাওর অঞ্চলের কৃষকরা। কম খরচে অধিক ফলন মিলে এবার সরিষা চাষে। পাশাপাশি সরিষা বিক্রি করে ভালো দামও পাওয়া যায়। তাই সরিষা চাষে দিন-দিন আগ্রহী হয়ে উঠছেন হাওরের কৃষকরা। 
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাতাসে হেলে দোলে সরিষা ফুলগুলো সুবাস ছড়িয়ে দিচ্ছে চারদিকে। জমি থেকে ভেসে আসা হলুদ বরণ সরিষা ফুলের কাঁচা মিষ্টি গন্ধে চারদিক এখন মাতোয়ারা। রোপা আমন কাটার পর বোরো আবাদের মাঝামাঝি সময়ে করা হয়েছে সরিষার আবাদ। সরিষা চাষ হাওরের কৃষকদের মাঝে এবার ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছে। অল্প সময়ে, অল্প খরচে অধিক ফলন পাওয়ায় এই সরিষা আবাদ হাওর অঞ্চলে দিন-দিন বাড়ছে। ফলে এই বছরও ভাল ফলনের আশা করছে এই অঞ্চলের কৃষকরা। কৃষি আবাদ থেকে হারিয়ে যাওয়া সরিষা আবার ফিরে এসেছে নতুন প্রত্যাশা, নতুন সম্ভাবনা। তবে এবার আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে হাওর অঞ্চলে সরিষার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন এখানকার কৃষকরা। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, গতবছরের চেয়ে এবার চলতি বছরে ৮ শতাংশ সরিষা আবাদ বৃদ্ধি হয়েছে হাওর এলাকায়।
জানা যায়, দেশের ৭ জেলায় ৮ লাখ ৫৮ হাজার ৪৬০ হেক্টর জায়গা জুড়ে মোট ৩৭৩টি হাওর রয়েছে। আয়তনের দিক থেকে সবচেয়ে বেশি হাওর রয়েছে সুনামগঞ্জে। এই জেলায় ২ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩১ হেক্টর ভূমিতে ৯৫টি হাওর রয়েছে। এই ছাড়া সিলেটে ১০৫, হবিগঞ্জে ১৪, মৌলভীবাজারে ৩, নেত্রকোনায় ৫২, কিশোরগঞ্জে ৯৭ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৭টি হাওর রয়েছে। এসব হাওর এলাকায় এবার সরিষা চাষে বিপ্লব ঘটেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া: হাওর বেষ্টিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা। এই জেলায় এবার সরিষার আবাদ বেড়েছে। বৃষ্টিপাত না হওয়ায় এখন পর্যন্ত মাঠের অবস্থা খুবই ভালো। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় চলতি মৌসুমে সরিষার বাম্পার ফলন হবে বলে আশা করছেন কৃষকরা। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্য মতে, এবার জেলায় সরিষা আবাদ হয়েছে ১৫ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে। তার মধ্যে হাওর বেষ্টিত নাসিরনগর উপজেলায় শুধু সরিষা চাষ হয়েছে ৬ হাজার ২০ হেক্টর জমিতে। তবে এবার এই জেলায় আবাদ বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে নতুন জাতের সম্প্রসারণ। নতুন জাতের বিনা-৯ ও বারি-১৪, ১৭ এবং ১৮ জাতের সরিষা। 
নাসিরনগরে হাওরের সরিষা চাষি আবুল কাশেম জানান- সরিষা চাষে খরচ কম। পাশাপাশি অধিক ফলন পাওয়া যায়। আরেক চাষি হোসেন মিয়া জানান- খুব কম সময়ে সরিষা আবাদ করা যায়। ফলে হাওরের দিনে-দিনে বাড়ছে সরিষা চাষের আবাদ। এই ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ সুশান্ত সাহা বলেন, ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটাতে এই বছর নতুন জাতের সরিষা আবাদ করা হয়েছে। সরিষার আবাদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে কৃষক সমাবেশের পাশাপাশি ২২ হাজার কৃষককে প্রতি ১ বিঘা জমির জন্য প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার দেয়া হয়েছে।  
কিশোরগঞ্জ: হাওর বেষ্টিত কিশোরগঞ্জ জেলায় এবার হাওরে অতিরিক্ত ফসল হিসেবে সরিষা চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। কম খরচে অধিক ফলনের পাশাপাশি দামও ভালো পাওয়া যায়। তাই সরিষা চাষে দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছেন হাওরের কৃষকেরা। জেলা কৃষি বিভাগ জানান- সরিষা চাষে কৃষকদের আগ্রহী করে তোলার পাশাপাশি কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সহযোগিতা করা হচ্ছে। চলতি বছরে জেলায় ৯ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ করা হয়েছে। এই ব্যাপারে জেলা কিশোরগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মো. আব্দুস সাত্তার জানান, ভোজ্য তেলের আমদানি নির্ভরতা কমাতে সরিষাকে বিকল্প হিসেবে দেখছে সরকার। সেই সঙ্গে খরচ ও চাষের সময় দুটোই কম হওয়ায় হাওর বেষ্টিত কিশোরগঞ্জ জেলায় কৃষকেদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে সরিষা চাষ। 
নেত্রকোনা: চলতি বছর নেত্রকোনায় ৫ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে। যা গত বছর ছিল ৪ হাজার ৭১৫ হেক্টর। জেলার সব উপজেলায় কম-বেশি সরিষার আবাদ হয়েছে। 
সুনামগঞ্জ: ভোজ্য তেলের চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি বেশি লাভজনক হওয়ায় সুনামগঞ্জে সরিষার আবাদ বেড়েছে। জেলা কৃষি বিভাগের তথ্যমতে সুনামগঞ্জ ২ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। ৪ হাজার ৩০০ জন কৃষকের মধ্যে বিনামূল্যে বীজ ও সার বিতরণ করা হয়। এই ব্যাপারে জেলা সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ বিমল চন্দ্র সোম জানান-  সরিষার আবাদ বাড়াতে কৃষকদের সার বীজ দিয়ে সহযোগিতা করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা সরকারি প্রণোদনা দেয়ার পাশাপাশি কৃষকদের সরিষা আবাদে উদ্বুদ্ধ করেছি। ফলে এ বছর মাঠের যে অবস্থা দেখতে পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে সরিষার বাম্পার ফলন হবে।
সিলেট: গতবছর আশানুরূপ ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় এবার সিলেটে ব্যাপক হারে বেড়েছে সরিষা চাষ। সিলেট জেলায় ৫ হাজার ৬৭৫ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। ২১ হাজার ৭০০ জন কৃষকরে মাঝে সার ও বীজ সরকারি ভাবে বিতরণ করা হয়েছে।
হবিগঞ্জ: এখন সরিষা ফুলের গন্ধ আর বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে হলুদ ফুলের সমারোহ হবিগঞ্জ পথে-ঘাটে। জেলায় এবার ৪ হাজার ২৫০ হেক্টর জমিতে সরিষা আবাদ হয়েছে। তারমধ্যে ১০ হাজার ৮৫০ জন কৃষকের মাঝে সারও বীজ সরকারি বিতরণ করা হয়েছে।
মৌলভীবাজার: জেলায় ৪ হাজার ৭৭৫ হেক্টর জমিতে চাষ হয়েছে সরিষা। ১৩ হাজার ১৫০ জন কৃষকের মাঝে সারও বীজ সরকারি বিতরণ করা হয়েছে। 
এই ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. ফেরদৌসী বেগম বলেন, এই হাওরের জমিগুলো বর্ষা মৌসুমের পরে ও বোরো চাষের আগে জমি পতিত পড়ে থাকতো। পতিত জমিগুলো কিভাবে চাষের আওতায় আনা যায় সেই লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তৈলবীজ গবেষণা কেন্দ্র। এই সরিষা থেকে উৎপাদিত তেল দিয়ে তেলের ঘাটতি কমবে। দেশ থেকে আমদানিকৃত সয়াবিন তেলে যে খরচ হয় তাও কমে আসবে। তিনি  আরও বলেন, এবার গতবছরের চেয়ে ৮ শতাংশ সরিষা চাষ বৃদ্ধি হয়েছে হাওর এলাকায়। এবার যে পরিমাণ জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে আগামীতে তা আরও বৃদ্ধি পাবে।