শিরোনাম
টাঙ্গাইল, ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ (বাসস) : জেলার পাহাড়ি অঞ্চলের লালমাটি কলা চাষের জন্য উর্বর হওয়ায় কৃষকরা এককালীন ফলন হলেও অন্য ফসলের তুলনায় কম খরচে বেশি লাভের কারণে কলা চাষে ঝুঁঁকছেন।
জানা গেছে, জেলার লালমাটি অধ্যুষিত উপজেলা মধুপর, ঘাটাইল ও সখীপুরের পাহাড়ি মাটি কলা চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় কলা চাষের প্রতি স্থানীয় কৃষকদের মাঝে আগ্রহ বাড়ছে। ইতোমধ্যে অনেক কৃষক কলা চাষে অর্থনৈতিকভাবে সফলও হয়েছেন। বেশ কিছুদিন পানামা পোকার আক্রমণে কলা চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে পোকার আক্রমণ অনেকাংশে কমে গেছে। ধান, পাটসহ প্রচলিত অন্যান্য ফসলের তুলনায় কলা চাষে শ্রম খুবই কম ব্যয় করতে হয়। বিক্রির ক্ষেত্রেও ঝামেলা নেই। কলার বাজার দরে সহজে ধস নামেনা। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকা অপেক্ষাকৃত উঁচু হওয়ায় সারা বছরেই কলার চাষ করা যায়।
জেলার মধুপুর, ঘাটাইল ও সখীপুর এ কিন উপজেলার উৎপাদিত কলা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে প্রায় ৭০-৮০ ভাগই চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা ছাড়াও ঢাকা, ময়মনসিংহ, জামালপুর, ফুলবাড়িয়া, সিলেট, ভৈরবসহ দেশের অন্য জেলাগুলোতে যাচ্ছে। স্থানীয় কলার পাইকারী বাজার মধুপুরের জলছত্র, গারোবাজার এবং সখীপুর উপজেলার কুতুবপুর বাজার কলার জন্য বিখ্যাত। এছাড়া আরও বেশকয়েক জায়গায় কলা বিক্রি করা হলেও তা সীমিত। এ তিনটি হাট থেকে প্রতিদিন ছোট-বড় মিলে ২০-৩০ ট্রাক ভর্তি কলা যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন এলাকায়। মধুপুরের জলছত্র সপ্তাহে দুই দিনব্যাপী কলার হাট হয়। এই দুই হাটেই কোটি টাকার উপরে কলা বিক্রি হয়। একই চিত্র সখীপুরের কুতুবপুর এবং মধুপুরের গারোবাজারে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসব বাজার বা হাটে পাইকাররা কলা কিনতে আসেন।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, এ অঞ্চলে বারিকলা-১ ও বারিকলা-২ (আনাজিকলা), অমৃতসাগর, মন্দিরা, মন্দিরা সাগর, সবরি, চম্পা, চিনিচাম্পা, কবরি, মেহেরসাগর, বীচিকলা ইত্যাদি জাতের কলা চাষ হয়ে থাকে। প্রতি বিঘা জমিতে ৩৫০ থেকে ৩৮০টি কলাগাছ রোপণ করা হয়। একটি কলা গাছে রোপণ থেকে বাজার জাত পর্যন্ত ১৫০ থেকে ২০০ টাকা খরচ হয়। প্রতিটি কলার ছড়ি ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি করা যায়। এ হিসেবে প্রতি বিঘায় প্রায় ৬০ হাজার টাকা কৃষকরা লাভের মুখ দেখেন।
সূত্র জানায়, কলায় প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, লৌহ ও ভিটামিন সি রয়েছে। পাকা কলা মানব দেহে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে এবং কলার থোড় বা মোচা ডায়াবেটিস, আমাশয়, আলসার নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। চলতি মৌসুমে জেলায় চার হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের কলা আবাদ করা হয়েছে। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি কলা চাষ হচ্ছে মধুপুরে। মহিষমারা, শোলাকুড়ী, বেরীবাইদ, অরণখোলা, কুড়াগাছা, কাকরাইদ, ভবানীটেকী, গরমবাজার, কাউচি বাজারসহ মধুপুরের বিভিন্ন গ্রামেই দুই হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে কলার চাষ হচ্ছে। এ বছর ঘাটাইল উপজেলায় ৯৫০ হেক্টর জমিতে কলা চাষ হয়েছে। সন্ধানপুর, সংগ্রামপুর, রসুলপুর, লক্ষিন্দর, ধলাপাড়া ও সাগরদিঘী ইউনিয়নে সবচেয়ে বেশি কলার আবাদ করা হয়েছে। এসব এলাকার কলার চাহিদা দিনদিন বাড়ছে। এর প্রভাব কলা চাষিদের মাঝেও পড়েছে। এ বছর উৎপাদিত কলা আগের বছরের চেয়ে কৃষকরা বেশি দামে বিক্রি করতে পারছেন। তবে এবারও কোন কোন এলাকায় পানামা রোগের প্রকোপ লক্ষ্য করা গেছে।
মধুপুরের মহিষমারা গ্রামের কৃষক ছানোয়ার হোসেন জানান, নিজের পৈতৃক জমি ও অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে তিনি বিভিন্ন ফলের চাষ করছেন। এবার পাঁচ বিঘা জমিতে ১৭০০টি কলার চারা রোপণ করেছেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে ফলন এবং লাভও দুটোই ভালো হবে। এখন শীতকাল থাকায় কলার দাম একটু কম যাচ্ছে। গরম উঠলেই কলার বাজার অনেক বেড়ে যাবে। তিনি জানান, মধুপুর গড়াঞ্চলে আনারসের সাথী ফসল হিসেবে প্রচুর পরিমাণে কলা চাষ হয়ে থাকে। কলা চাষের সাথে কচু, আদা, হলুদ ও আনারস সহজেই চাষ করা যায়। এ অঞ্চলের অধিকাংশ কৃষক কলার সাথে কচু ও আদা-হলুদ চাষ করে থাকেন। এতে এক জমিতে দুই-তিন ফসল আবাদ করা যায়। তরুণ কলা চাষি আব্দুস সাত্তার জানান, পাহাড়ি অঞ্চল কলা চাষের জন্য খুবই উপযোগী হওয়ায় কলা চাষে অন্য ফসলের চেয়ে বেশি লাভবান হওয়া যায়। তাই বেকার যুবকদের চাকরির পিছনে না ছুটে কলা চাষে মনোনিবেশ করার পরামর্শ দেন তিনি।
কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, তিনি এবার প্রথম সবরি কলার চাষ করেছেন। এখন পর্যন্ত কলা গাছগুলো সুস্থ-সবল থাকায় ভালো ফলনের আশা করছেন। কৃষি কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পেলে আগামীতে আরও বেশি জমিতে কলার চাষ করার আশা করেন তিনি। মধুপুরে কাকরাইদ গ্রামের কলা চাষি মাসুদ রানা জানান, তিনি আনারসের পাশাপাশি কলা ও পেঁপে চাষ করে থাকেন। করোনার মহামারির সময় কলাসহ বিভিন্ন ফসলে ব্যাপক লোকসান হয়েছিল। এ বছর কলার বাম্পার ফলন হবে আশা করছেন।
মধুপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আল মামুন রাসেল জানান, এ বছর মধুপুর উপজেলায় কলা চাষ কিছুটা কম হয়েছে। কারণ একই জমিতে বারবার কলা চাষ করলে মাটির উর্বরতা কমে যায়। সেই সাথে পানামা পোকার আক্রমণে কলা চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারপরও এবার মধুপুর উপজেলায় দুই হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে কলার চাষ হয়েছে। এ বছর লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ভালো ফলনের আশা করা হচ্ছে।
টাঙ্গাইল কৃষি সম্প্রাসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আহসানুল বাসার জানান, চলতি মৌসুমে টাঙ্গাইল জেলায় চার হাজার ৬৬৭ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন জাতের কলা আবাদ করা হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি কলা চাষ হচ্ছে মধুপুর উপজেলায়। এছাড়া ঘাটাইল ও সখীপুর উপজেলায়ও কলা আবাদ করা হয়েছে। এক ফসল হলেও অন্য ফসলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি লাভবান হওয়ায় এ অঞ্চলের বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলের কৃষকরা কলা চাষে ঝুঁকছেন।