বাসস
  ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৪১
আপডেট : ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ১৭:৪৩

তথ্য প্রযু্িক্ত সুবিধা কাজে লাগিয়ে লাভবান হচ্ছেন রাজশাহীর কৃষকরা

॥ ড. মো. আয়নাল হক ॥
রাজশাহী, ৩০ এপ্রিল, ২০২৩ (বাসস) : তথ্য প্রযুক্তির সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কৃষিতে লাভবান হচ্ছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। মাটির উর্বরতা রক্ষা এবং উৎপাদন খরচ কমানোর পাশাপাশি পর্যাপ্ত ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে তৃণমূল কৃষকদের আস্থা যোগাচ্ছে তথ্য প্রযুক্তি। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ডিভাইস এবং অ্যাপস ভিত্তিক জ্ঞানসহ বিভিন্ন ধরণের পরিষেবাগুলো তাৎক্ষণিকভাবে কৃষকদের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে সরকার। যা কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। 
কৃষক মনিরুল ইসলাম (৪০) ‘খামারী অ্যাপ’ ব্যবহার করে কৃষিক্ষেত্রে সুষম সার প্রয়োগের ক্ষমতা অর্জনের ক্ষেত্রে একজন ‘আইকন’ হয়ে উঠেছেন- যা কৃষকদের নির্বিচারে সার প্রয়োগে নিরুৎসাহিত করছে। 
সুষম সারের প্রয়োগ মাটির উর্বরতা রক্ষা ও ফসলের ফলন বাড়ানোর পাশাপাশি মাটির প্রোটিনের চাহিদা মেটাচ্ছে। যা প্রত্যেক মৌসুমে সার খরচ থেকে ৫০ হাজার টাকা সাশ্রয় করছে। তিনি বলেন, ‘আমার ধান, গম, তরমুজ, ভুট্টা ও সরিষা চাষের উপযুক্ত ১৬ বিঘা জমি আছে। ডিজিটাল ডিভাইস ব্যবহার করে প্রতি   মৌসুমে আমার জমিতে অতিরিক্ত প্রায় ৬০ হাজার টাকা মূল্যমানের ফসল ফলছে। 
তিনি বলেন, ‘খামারি অ্যাপটি কৃষক এবং অন্যান্য সুবিধাভোগীদের জন্য সময়োপযোগী ও চাহিদা-ভিত্তিক সেবা দিয়ে থাকে। খামারি মোবাইল অ্যাপ ফসলের ফলন বাড়াতে অনেক অবদান রাখছে। কারণ এটি কৃষি সংক্রান্ত তথ্য ও ফলাফলের ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে খুবই কার্যকর।’
ইউনিয়ন পরিষদের কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র থেকে আবহাওয়া, কীটপতঙ্গ ব্যবস্থাপনা, সেচ ও সার সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য ও পরামর্শ গ্রহণের পর দেউপাড়া গ্রামের আরেক কৃষক আনিসুজ্জামান ডলার (৪৮) ফসল চাষে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন। দেউপাড়া কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্রের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের একজন সদস্য হিসেবে তিনি কৃষি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত সব ধরণের প্রয়োজনীয় ও জরুরি তথ্য তার বাড়ি বা কৃষিক্ষেত্র থেকে তাৎক্ষণিকভাবে পেয়ে থাকেন বলে এই প্রতিবেদককে জানান। 
নাজিরপুর গ্রামের কৃষক শফিকুল ইসলাম (৪৫) রিপার, বাইন্ডার, থ্র্যাসার, পাওয়ার থ্রেসাার, ওয়াইডার, হ্যান্ড ওয়াইডার, সার স্প্রে করার মেশিন, বেড প্ল্যান্টার, বীজ বপনের ট্রে এবং স্ট্রিপ টিলাজ ব্যবহারের মাধ্যমে ধানের চারা উৎপাদন করে একজন ডিজিটাল কৃষি উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছেন। প্রায় ২৫০ জন কৃষকের সাথে তার একটি ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ রয়েছে। সেখানে কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী তিনি সেবা দিয়ে থাকেন। আধুনিক তথ্য প্রযুক্তি সর্বোচ্চ ব্যবহার করে 
এই বিশাল বরেন্দ্রভূমিসহ এই অঞ্চলের কৃষকরা তাদের ভাগ্য পরিবর্তন করেছে। এই অগ্রগতির ফলে কৃষি খাতে উদ্যোক্তার সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে যা,এই অঞ্চলের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। 
২০২০ সালের শেষের দিকে গোদাগাড়ী উপজেলার ঈশ্বরীপুর এলাকার দুই তরুণ যৌথভাবে সারওয়ার রশিদ এবং নুরুল্লাহ সাদেকিন ১২ বিঘা জমি লিজ নিয়ে ডিজিটাল ফার্মিং চালু করার পর উচ্চ মূল্যের ফলন ও ফসল চাষে বিনিয়োগ করেছেন। 
সারওয়ার রশিদ তাদের ব্যবসায়িক কৌশল ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেন, ‘তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি ফলন এবং মুনাফা পাওয়ার জন্য আমরা কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং ডিজিটালাইজেশন যুক্ত করেছি। চাষকে আরও লাভজনক করার জন্য স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা গ্রহণ করছি। আমরা তরমুজের কলম চারা উৎপাদন ও বিক্রির ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই সফলতা লাভ করেছি।’ তারা কৃষকদের মাঝে গ্রীষ্মকালীন তরমুজ, ফুলকপি ও বাঁধাকপির চারা সরবরাহ করে যাচ্ছেন বলেও জানান।
উপ-সহকারি কৃষি কর্মকতা অতনু সরকার বাসস’কে জানান, কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্রের প্রত্যেক সদস্যেরই বীজের নমুনা, ফসল উৎপাদনের কৌশল প্রচারের জন্য লিফলেট, স্প্রে মেশিন, সম্পূরক সেচের জন্য ফিতা পাইপ, বীজের আদ্রতা পরীক্ষা করার জন্য মিটার রয়েছে। এসব যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য কৃষকদের বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘আমরা ওই গ্রুপের সদস্যদের কাছে ফোন, ই-মেইল ও বাংলা এসএমএস ব্যবহার করে প্রয়োজনীয় মেসেজ পাঠিয়ে যাচ্ছি। ‘হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, জুম ও স্কাইপের মতো ওয়েব-ভিত্তিক প্রযুক্তিও এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মারিয়াম আহমেদ বলেন, কৃষকরা অ্যাপের মাধ্যমে মৌসুম-ভিত্তিক শস্য, জমির উর্বরতা, সার পরামর্শ, উৎপাদন পরামর্শ, বীজসহ নানা ধরনের জরুরি তথ্য পাচ্ছেন। তারা ক্রপ জোনিং, শস্য বৈচিত্র, শস্য উৎপাদন ও কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান সংগ্রহ করছে। এই অ্যাপটি  কৃষিক্ষেত্রে এক নব-দিগন্তের সূচনা করেছে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল ও দূরদর্শী নেতৃত্বে বর্তমান সরকার কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং কৃষি প্রযুক্তির প্রচার ও ডিজিটালাইজেশনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক শামসুল ওয়াদুদ বলেন, ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা মেটাতে তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারকে ফলন বাড়ানোর একটি নিশ্চিত উপায় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবসহ বিদ্যমান সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পূর্বশর্ত হলো আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ও টেকসই ব্যবহার।
তিনি বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি কর্মসূচির অধীনে তৃণমূল কৃষকদের কাছে আধুনিক কৃষি তথ্য ও বার্তা প্রদানের লক্ষ্যে বিভিন্ন ইউনিয়নে কৃষক তথ্য ও পরামর্শ কেন্দ্র পরিচালনা করা হচ্ছে। এখান থেকে তৃণমূল কৃষকদের সুবিধার জন্য কিছু জরুরি সেবাসহ প্রায় ১২ ধরনের সেবা প্রদান করা হচ্ছে। যেসব এলাকায় সশরীরে পৌঁছানো কষ্টকর, সেখানে ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপ-এর মাধ্যমে কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।