।। হাবিবুর রহমান ।।
ঢাকা, ৬ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই হচ্ছে একটি পরিচ্ছন্ন, সুষ্টু, নিরপেক্ষ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। আওয়ামী লীগ শাসনামলে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল, দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সম্পুর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছিল।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে দায়িত্ব নেয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিয়ে একটি প্রতিনিধিত্বশীল জনগণের নির্বাচিত সরকারের জন্য কাজ করছে। অপরদিকে নির্বাচন কমিশন গত একবছরে সংস্কার, নির্বাচনী বিধি বিধান কঠোর প্রয়োগ, দেশের তরুণ সমাজ এবং প্রবাসীদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্র সংস্কারে অংশীদার করার কাজ করছে।
ইসি জানায়, জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী হিসেবে পরিচিত জুলাই গণ বিপ্লবে পলাতক আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যক্রমে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় ইসি রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত রেখেছে। ফলে দলটি আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেনা। তবে তফসিলে দলটির নৌকা প্রতীক সংরক্ষিত থাকলেও অন্য কেউ এই প্রতীক ব্যবহার করতে পারবে না।
নির্বাচন কমিশন জানায়, তারা দায়িত্ব নেয়ার পর বিগত সরকারের সময়ে অনুষ্ঠিত তিনটি নির্বাচনে দলীয় আধিপত্যের কারণে বিধ্বস্ত নির্বাচনী কাঠামো থেকে পুনরুদ্ধার করে জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেয়ার কাজ শুরু করেছে। আওয়ামী লীগের সেই নির্বাচন নিয়ে দেশের জনগণ এবং গণতান্ত্রিক বিশ্ব প্রশ্ন তুলেছে। দিনের ভোট রাতে করা, বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিতদের নিয়ে সরকার গঠন এবং ‘আমি আর ডামি’ নির্বাচনের অভিধায় ভুষিত এসব নির্বাচনকে বিশ্বের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলো মেনে নিতে পারেনি।
ইসি সুত্র জানায়, ১৫ বছরে স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ধ্বংস করে অনেকটা একদলীয় ধাচের আওয়ামীতন্ত্র চালুর বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতা গর্জে উঠেছিল ২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে। এই আন্দোলনে স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সরকার পালিয়ে যাবার পর দেশের মানুষ আবার নিজেরা নিজেদের ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার স্বপ্ন দেখছে।
কমিশন জানান,অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর জুলাই বিপ্লবের স্পিরিট সমুন্নত রেখে গত এক বছরে আওয়ামী শাসনের সময় ধ্বংস করা নির্বাচন পদ্ধতি থেকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। রাজনৈতিক সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনী সংস্কারের কাজে হাত নিয়েছে সরকার।
২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বরে শপথ নেয়ার পর থেকে নির্বাচন কমিশন (ইসি) আসন্ন ত্রয়োদশ নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করার প্রস্তুতিমূলক কাজ শুরু করেছে। দেশের সব রাজনৈতিক দল গুলোর সাথে সংলাপ ও পরামর্শ করে মানুষের মৌলিক অধিকার প্রয়োগের কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রথমবার প্রবাসীরা ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে যাচ্ছে।
ইসি সচিবালয় জানায়, ত্রয়োদশ নির্বাচনের ঘোষণা আসার সাথে সাথেই নির্বাচনী মাঠের বিশ্বাসযোগ্য আবহ তৈরি করতে কমিশনের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। নির্বাচনের প্রস্তুতির বিষয়ে সম্প্রতি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) একটি অবাদ, সুষ্ঠ, বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে কাজ করে যাচ্ছে এবং সেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমরা একটা ফ্রি ফেয়ার অ্যান্ড ক্রেডিবল ইলেকশন জাতিকে উপহার দিতে পারি, সেই লক্ষ্যেই আমরা প্রস্তুতিটা নিচ্ছি।
তিনি বলেন, ‘আমরা ১৫ বছর ধরে লড়াই করেছি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আমি মনে করি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য আমরা অর্ধেক পথ এগিয়ে গিয়েছি।
যেদিন ভোটাররা একদম নিশ্চিন্তে, নিজস্ব উদ্যোগে এবং বিনা বাধায় নিজের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে বুথ থেকে বের হতে পারবে, সেই দিনই আমরা বলবো ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
তিনি বলেন, ভোটকে এখন আমি দায়িত্ব হিসেবে প্রচার করতে চাই। এখন প্রত্যেকটা নাগরিকের দায়িত্ব হচ্ছে কেন্দ্রে এসে ভোট দেওয়া। সবাই যাতে ভোট কেন্দ্রে আসেন এবং ভোট দেন, সেজন্য গণমাধ্যমের কর্মীরাও ভূমিকা রাখবেন।
সিইসি বলেন, ‘দিনের ভোট দিনেই হবে, রাতে নয়’। তিনি বলেন, ‘আমরা রাতের আঁধারে কিছু করতে চাই না, দিনের আলোতেই সব কার্যক্রম হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেই আমরা একটি সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে চাই। তা না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে।’
সম্প্রতি গণমাধ্যমের সাথে আলাপকালে সিইস বলেন, আমরা সবাই মিলে ১৯৯১ সালে একটি সুষ্ঠ নির্বাচন উপহার দিয়েছি। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০১ সালে সুষ্ঠু নির্বাচন দিয়েছি। এখন কেন পারব না। আমাদের পারতেই হবে। ২০১৮ সালের মতো অভিযোগ আর যেন না ওঠে। প্রশাসন, পুলিশ, প্রিসাইডিং অফিসারসহ সব কর্মকর্তাদের বলব এটা ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের সময়। প্রমাণ করুন, আমরা পারি।’
ভোটের তারিখ দুই মাস আগে জানানো হবে জানিয়ে সিইসি বলেন, ‘ভোটের নির্দিষ্ট তারিখ এখনো নির্ধারিত হয়নি। নির্বাচনের তারিখ আমিও জানিনা। তবে কমপক্ষে দুই মাস আগেই সবকিছু জানিয়ে দেওয়া হবে। কোন দিন ভোট, কোন দিন মনোনয়ন, সমস্ত ডিটেইলসহ জানিয়ে দেব। এ জন্য ধৈর্যধারণ করতে হবে।’
গত ১০ জুলাই কমিশন অষ্টম সভা করেছে। সেই সভায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও), নির্বাচন কর্মকর্তা বিশেষ আইন, হলফনামা, ইসি সচিবালয় আইন, পোস্টাল ব্যালট, ইভিএম, দল নিবন্ধন অগ্রগতি, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, সীমানা নির্ধারণসহ সার্বিক বিষয়ে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ আমলে নিয়ে তা বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আগামী ১০ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
দাবি আপত্তি নিষ্পত্তির পর ৩১ আগস্টের মধ্যে চূড়ান্ত হবে। এবার তিনটি তালিকা হচ্ছে। সংশোধিত আইন অনুযায়ী, সর্বশেষ ভোটের একমাস আগে সম্পুরক তালিকা প্রকাশ হবে। যাতে নতুন ভোটাররা যুক্ত হবেন বলে ইসি জানায়।
ইসি সচিব আখতার আহমেদ জানিয়েছেন, ভোটারের তালিকায় এবার ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার নতুন ভোটার যুক্ত হয়েছে। কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়েছে এই ৪৪ লাখ ৬৬ হাজার নতুন ভোটার এবার তালিকায় আসবে। প্রবাসী ভোটাররা পোস্টাল ব্যলটের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগের লক্ষ্যে প্রকল্প অনুমোদনের প্রক্রিয়া চলছে। এতে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ইতোমধ্যে ৩৯টি সংসদীয় আসনে সীমানা পরিবর্তনের খসড়া প্রস্তাব অনুমোদন হয়েছে। এমাসের (আগস্ট) মধ্যে দাবি আপত্তি শুনানি করে সংসদীয় সীমানা তালিকা প্রকাশ করা হবে।
আখতার বলেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিবন্ধন পাওয়ার জন্য নির্বাচন কমিশনে (ইসি) আবেদন করেছে ১৪৫টি রাজনৈতিক দল। তবে যাচাই-বাছাই করে নিবন্ধন প্রত্যাশী সব দলেরই আবেদনে তথ্যের ঘাটতি পেয়েছে ইসি। ইতিমধ্যে সব দলকে ত্রুটি সংশোধনে জন্য ইসির পক্ষ থেকে ১৫ দিন সময় দিয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। ঘাটতি তথ্য দিতে নির্দেশ দেওয়ার পর ৮০টি দল ঘাটতি সংক্রান্ত কাগজপত্র জমা দিয়েছে। তাদের বিষয়ে পরবর্তী রিভিউ করছি। ৬ টি দল সময় চেয়েছে। বাকি ৫৯টি দল কোনো জবাব দেয়নি। যে দলগুলো জবাব দেয়নি এবং যারা সময় চেয়েছেন তাদের বিষয়গুলো কমিশনে পাঠাবো।
তিনি জানান, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ ধীরে ধীরে আগাচ্ছে। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের যথাসময়ে প্রশিক্ষণের পরিকল্পনা রয়েছে। ভোটের জন্য সব ধরনের নির্বাচন সামগ্রী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কেনাকাটা শেষ করা হবে। তিনি জানান, ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) পর্যবেক্ষণ টিম মিড সেপ্টেম্বরে দেশে আসবে। এরমধ্যে তিনজন বিদেশি ও চার জন স্থানীয় পর্যবেক্ষক থাকবেন। প্রি-ইলেকশন এনভায়রনমেন্ট অবজারভেশনের জন্য তারা আসবেন। ইসির প্রস্তুতি কি আছে না আছে সেগুলো দেখার জন্য তারা আসবেন।
ইসি সচিবালয় সুত্র জানায়, কমিশন সভায় ভোটকেন্দ্র স্থাপনে নির্বাচন কর্মকর্তাদের একক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে আগের কমিশন ইসি কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও পুলিশ সুপারদের (এসপি) হাতে ক্ষমতা অর্পণ করেছিল। কমিশন এবার সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করে দিয়েছে। এক্ষেত্রে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের হাতেই ফের কর্তৃত্ব দিয়েছে। শুধু তাই নয়, ভোটকেন্দ্র সংস্কারের মতো উদ্যোগও হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) নীতিমালায় ভোটের আগে-পরে তিন দিন পর্যবেক্ষক সংস্থা মোতায়েনের বিধান রাখা হয়েছে। এছাড়া পর্যবেক্ষক হতে এইচএসসি পাস বা সমমানের শিক্ষাগত যোগ্যতা নির্ধারণ করা হয়েছে। একইসাথে পর্যবেক্ষকদের সর্বনিম্ন বয়স ২১ বছর করা হয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণ বিধিমালা, ২০২৫ এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিধিমালায় আসন্ন সংসদ নির্বাচনে পোস্টারের ব্যবহার বন্ধ, বিধি লঙ্ঘনে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা জরিমানা ও প্রচার প্রচারণায় পরিবেশ বান্ধব সামগ্রী ব্যবহারের নতুন বিধান যুক্ত করা হয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য খাতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) জন্য জাতীয় বাজেটে দুই হাজার ৯৫৬ কোটি টাকা ইতোমধ্যে বরাদ্দ রেখেছে অন্তর্বর্তী সরকার।
এরমধ্যে পরিচালনা খাতে দুই হাজার ৭২৬ কোটি ৯৫ লাখ টাকা, আর উন্নয়ন খাতে ২২৯ কোটি পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অন্যান্য নির্বাচনও রয়েছে।
এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ বলেন, আশা করি বরাদ্দকৃত বাজেটের মধ্যেই হয়ে যাবে। যদি না হয় সেটা পরে দেখা যাবে। এ নিয়ে কোনো সমস্যা হবে বলে মনে করছি না।