আবু সাঈদের মৃত্যুর খবর শুনে আমার মাথায় আসমান ভেঙে পড়ে : বাবা

বাসস
প্রকাশ: ২৮ আগস্ট ২০২৫, ১৫:০০
ফাইল ছবি

ঢাকা, ২৮ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : সেদিন প্রথমে শুনি আবু সাঈদের গুলি লেগেছে, পরে শুনি আমার আবু সাঈদ মারা গেছে। এই খবর শুনে আমার মাথায় আসমান ভেঙে পড়ে।

কথাগুলো বলছিলেন শহীদ আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন। 

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শহীদ আবু সাঈদ হত্যা মামলায় আজ সাক্ষীর জবানবন্দি দেন তিনি।

বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এ দেওয়া জবানবন্দিতে আবু সাঈদের ৮৫ বছর বয়সী বাবা আরো বলেন, আমি শহীদ আবু সাঈদের পিতা। আমার ছেলে আবু সাঈদ মেধাবী ছাত্র ছিল। সে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পেয়েছিল এবং এসএসসিতে গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছিল। সে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিল। 

আবু সাঈদ টিউশনি করে নিজের খরচ চালাত বলে জানান তিনি।

জবানবন্দিতে আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেন আরো বলেন, ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই আমি মাঠ থেকে কাজ করে বাড়িতে এসে দেখি সবাই কান্নাকাটি করছে। প্রথমে শুনি, আবু সাঈদের গুলি লেগেছে। পরে শুনি, আমার আবু সাঈদ মারা গেছে। এই খবর শুনে আমার মাথায় আসমান ভেঙে পড়ে। (এ সময়  ট্রাইব্যুনালে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন আবু সাঈদের বাবা)।

মকবুল হোসেন বলেন, রাত সাড়ে তিনটার দিকে আবু সাঈদের লাশ বাড়িতে আসে। প্রশাসন বলে, রাতেই লাস দাফন করতে হবে। আমি বলি, রাতে দাফন সম্ভব না। পরদিন সকালে দুইবার জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে আবু সাঈদকে দাফন করা হয়। আবু সাঈদকে গোসল করানোর সময় দেখি তার মাথার পেছন থেকে রক্ত ঝরছিল আর রক্তে ভাসা বুক গুলিতে ঝাঝরা ছিলো। পরে শুনতে পারি যে, আমির ও সুজন চন্দ্র আমার ছেলেকে গুলি করে। এর কয়েকদিন আগে ছাত্রলীগ নেতা পোমেল বড়ুয়া আবু সাঈদের গলা চেপে ধরে তাকে থাপ্পড় মেরেছিল।

আবু সাঈদকে যারা নির্মমভাবে শহীদ করেছে ট্র্যাইব্যুনালের কাছে তার কঠোর বিচার চেয়ে মকবুল হোসেন জবানবন্দিতে বলেন, ‘আমি মানুষের কাছে বলতাম, জীবিত থাকতে যেন ছেলের চাকরি করা দেখে যেতে পারি। এখন আমি চাই, আমি জীবিত থাকতে যেন আমার ছেলের হত্যার বিচার দেখে যেতে পারি।’

গতকাল এই মামলার সূচনা বক্তব্যে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম ট্রাইব্যুনালকে বলেন, বাংলা পঞ্জিকায় দিনটি ছিল আষাঢ়ের শেষ দিন। একদিন পরই শুরু হয় শ্রাবণ। সেদিন সকালে রংপুরের আকাশে ঝরছিল বৃষ্টি। কিন্তু সব উপেক্ষা করে ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে ওঠে উত্তরের শহর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পূর্বঘোষিত কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই বিশাল প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন বেরোবি’র শিক্ষার্থীসহ স্কুল-কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা, যা ছিল তারুণ্যের দ্রোহযাত্রা ও  বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। নগরীর লালবাগ এলাকা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বিক্ষোভ মিছিল এগিয়ে এলে, শিক্ষার্থীদের বাধা দেয় অসংখ্য সশস্ত্র পুলিশ। তাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের বাকবিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে কাঁদানে গ্যাস ও সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয় পুলিশ। 

তিনি আরো বলেন, এছাড়া এই মামলার পাঁচ নম্বর আসামি মো. আরিফুজ্জামান ওরফে জীবনের নেতৃত্বে পাঁচ জন পুলিশ সদস্য স্টিল ও কাঠের লাঠি দিয়ে আবু সাঈদের মাথায় আঘাত করেন। এতে তার মাথা থেকে রক্ত বের হয়।

চিফ প্রসিকিউটর তার সূচনা বক্তব্যে বলেন, ওই দিন আষাঢ়ের বাদল কিংবা মেঘ না থাকলেও, বৃষ্টি ঝরেছিল। সে বৃষ্টি গুলির। তাই বৃষ্টিতে পানি না ঝরলেও ঝরেছিল নিরপরাধ ছাত্র-জনতার রক্ত। সেখানেই জুলাই বিপ্লবের সাহসের উজ্জ্বল প্রদীপ হয়ে জ্বলে উঠেছিল শহীদ আবু সাঈদ। পুলিশের লাঠিচার্জে রক্তাক্ত হয়েও দুহাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে তিনি যেন বলতে চেয়েছিলেন, ‘এভাবে মানুষ মারা চলবে না।’ কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের বাঁচাতে চাইলেন যিনি, ঠিক তার বুকেই তাক করা হলো বন্দুকের নল। ঘড়ির কাঁটায় তখন দুপুর ২টা ১৭ মিনিট। ঠিক তখনই গর্জে ওঠে মামলার আট নম্বর আসামি পুলিশের সাবেক এএসআই মো. আমির হোসেনের রাইফেল। যে অস্ত্র কেনা হয়েছিল আবু সাঈদের ট্যাক্সের টাকায়, শত্রুর বিরুদ্ধে ব্যাবহারের জন্য। সে অস্ত্রই বিদ্ধ করল আবু সাঈদকে। প্রথম গুলিটি যখন আবু সাঈদের পেটে লাগে, তখন তিনি হতবাক হয়ে যান। আবার বুক প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে যান। তখনই তাকে পরপর দুই রাউন্ড গুলি করেন ৯ নম্বর আসামি সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায়। এরপর রাস্তার ডিভাইডার পার হয়ে বসে পড়েন আবু সাঈদ। একজন সহযোদ্ধা তাকে মাটি থেকে তোলার জন্য ধরতে গেলে আবার সে পড়ে যান। আবু সাঈদকে নেয়ার সময় তাদের লক্ষ্য করে আবার গুলি চালায় পুলিশ। এতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাওহিদুর হক সিয়ামের শরীরের বাঁ দিকটি ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। প্রায় ৬০টি ছররা গুলি তার মাথা, মুখ-হাত, বাহু, পেট, কোমর ও পায়ের বাঁ দিকে বিদ্ধ হয়। আবু সাঈদকে নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্ররা রিকশায় করে রওনা দেন রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে উদ্দেশ্যে। হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি সহযোদ্ধাদের বাহুডোরেই ঢলে পড়েন মৃত্যুর কোলে।’

চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্র্যাইব্যুনালের কাছে এরকম মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনা ও তার দোসরদের বিচার চান।

গত ৩০ জুলাই প্রসিকিউসনের পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম এই মামলায় অভিযোগ গঠনের প্রার্থনা করেন। অন্যদিকে, আসামী পক্ষে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি চাওয়া হয়। এরপর গত ৬ আগস্ট ট্র্যাইব্যুনাল এই মামলায় আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে সূচনা বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য ২৭ আগস্ট দিন ধার্য করেন।

এই মামলার যে ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ আনা হয়, তাদের মধ্যে গ্রেফতারকৃত ৬ জন আজ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় হাজির ছিলেন। 

এরা হলেন- বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রক্টর শরিফুল ইসলাম, সাবেক সহকারী রেজিস্ট্রার রাফিউল হাসান রাসেল, রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের চুক্তিভিত্তিক সাবেক কর্মচারী মো. আনোয়ার পারভেজ, পুলিশের সাবেক সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) আমির হোসেন, সাবেক কনস্টেবল সুজন চন্দ্র রায় ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের নেতা ইমরান চৌধুরী ওরফে আকাশ।

আবু সাঈদ হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গত ৩০ জুন ৩০ জনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আমলে নেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২।

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল, তখন ১৬ জুলাই দুপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পার্ক মোড়ে গুলিবিদ্ধ হন আবু সাঈদ। ২৫ বছর বয়সী আবু সাঈদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোটা সংস্কার আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নিরস্ত্র আবু সাঈদের পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়লে, সারা দেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদেই সোচ্চার হন বহু মানুষ, যাতে আরও গতিশীল হয় কোটা সংস্কার আন্দোলন। 

ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা।

গত বছরের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলন নির্মূলে আওয়ামী লীগ সরকার, তার দলীয় ক্যাডার ও সরকারের অনুগত প্রশাসনসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি অংশ গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত করে বলে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়ে। জাজ্জ্বল্যমান এসব অপরাধের বিচার এখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুটি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
কুমিল্লায় লরিচাপায় এবার প্রবাসী নিহত
সিভাসুতে সামুদ্রিক মাছের পুষ্টিতথ্য নিয়ে বই’র মোড়ক উন্মোচন 
মৃত্যুদণ্ড বজায় রেখে গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশের খসড়া অনুমোদন
কর্ণফুলী টানেল বহির্ভূত খাতে ৫৮৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ : ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে দুদকের প্রথম মামলা 
লালমনিরহাটে পাটের চড়া দামে সুদিনের আশা কৃষকের 
আইন মন্ত্রণালয়ের নতুন সচিব লিয়াকত আলী মোল্লা
অক্টোবরে কক্সবাজার বিমানবন্দরে আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল শুরু হবে : শেখ বশিরউদ্দীন
মোংলা ইপিজেডে এলইডি ও প্যাকিং সামগ্রী তৈরি করবে চীনা প্রতিষ্ঠান সেনশিন বিডি
কিয়েভে প্রাণঘাতী হামলায় রাশিয়ার সমালোচনা করলেন মাখোঁ
বিজিএমইএ’র সোয়েটার বিষয়ক স্থায়ী কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত
১০