ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়াতে সতর্কতা ও সচেতনতায় গুরুত্বারোপ

বাসস
প্রকাশ: ২৩ নভেম্বর ২০২৫, ২০:৪৭

 ঢাকা, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : আতঙ্কিত না হয়ে ভূমিকম্পের ঝুঁকি এড়াতে সতর্কতা ও সচেতনতার বিকল্প নেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দু’দিন আগে ঘটে যাওয়া ভূমিকম্পের মতো ভবিষ্যতে আরো হতে পারে। তাই এখনই সচেতন হওয়া জরুরি।

রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহর অধিক ভূমিকম্প ঝুঁকিতে রয়েছে। নগরীতে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, ভূমির প্রতি অনাচার, অপরিকল্পিত নগরায়ন, ভূমির তলদেশের পরিবর্তন সম্পর্কে উদাসীনতা ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আর বাংলাদেশ একটি টেকটোনিক অঞ্চলে অবস্থিত রয়েছে, তাই ঝুঁকি আরো বেশি। ভূমি সহনশীল বিল্ডিং কোড মানা হলে বড় ধরনের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা কম হবে বলেও জানান তারা।

ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিজাস্টার সায়েন্স অ্যান্ড ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. জিল্লুর রহমান বাসস’কে বলেন, শুক্রবার অনুভূত হওয়া ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির তীব্রতা গত ৫০ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মাত্রার। ভূতাত্ত্বিক হিসেবে বুঝতে চেষ্টা করি— ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলের আশেপাশে কোনো ফল্টলাইন আছে কি না। দেখা গেছে, নরসিংদীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শীতলক্ষ্যা নদীটি একটি লিনিয়ার (ফল্টলাইনযুক্ত) নদী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এর আগেও ৭ থেকে ৭ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্পের ঘটনা ঘটেছে। আগামীতেও এ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
 
তিনি বলেন, মাঝারি ধরনের ভূমিকম্প এবারই প্রথম বাংলাদেশে হচ্ছে এমনটা নয়, এর আগেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অনুভূত হয়েছে। কমবেশি ৫ দশমিক ৭ মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। গত ৫৮ ঘণ্টায় চারবারের মধ্যে ৫ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটির তীব্রতা ঢাকাসহ এর আশেপাশের এলাকায় ভূমিকম্পের তীব্রতা অপেক্ষাকৃত বেশি ছিল। বাংলাদেশ মাঝারি মানের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চল। এখানে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হওয়াটা অস্বাভাবিক নয় বলে উল্লেখ করেন এই বিশেষজ্ঞ। 

ড. জিল্লুর আরো বলেন, ভূমিকম্প  সহনশীল বিল্ডিং নির্মাণের জন্য বিল্ডিং কোডের সঠিক ইনডেনসিটি প্যারামিটার যুক্ত করা হয়েছে। তাই  বিল্ডিং কোড মানা হলে বড় ধরনের ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির  সম্ভাবনা কমে যাবে। 

নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর এবং সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিসেসের (সিআইআরএস) পরিচালক ড. মিনহাজ মোহাম্মদ শাহরিয়ার বাসস’কে বলেন, সম্প্রতি বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতির এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ ভূতাত্ত্বিকদের মতে, বাংলাদেশের জিওগ্রাফিক-জিওলজিক্যাল-টেকটোনিক অবস্থান খুবই জটিল। তবে, বাংলাদেশ  স্পষ্টভাবে সাবডাকশন সম্পর্কিত প্লেট বাউন্ডারিতে অবস্থিত। ইন্ডিয়ান প্লেটটি বার্মিজ প্লেটের নিচে যাওয়া শুরু করেছে কয়েক লাখ বছর আগে। এর ফলেই, চট্টগ্রাম, সিলেটের পাহাড়গুলো তৈরি হয়েছে। প্লেট দু’টির চাপ এখনো চলমান রয়েছে।  তবে, এর গতি ও প্রকৃতি বোঝার জন্য আরো সমীক্ষা ও গবেষণা প্রয়োজন।

তিনি আরো বলেন, ভূমিকম্পের যেহেতু কোনো আগাম সতর্কবার্তা নেই এবং কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই, প্রস্তুতি না থাকলে ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ভূমিকম্প বিষয়ে জ্ঞানের চর্চা, পরিকল্পনা আর একটু সচেতনতা আমাদের জীবন বাঁচাতে পারে। 

তিনি বলেন, নরসিংদীর ভূমিকম্প আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চল মোটেও স্থির নয়। সাম্প্রতিক ভূমিকম্প ভূগর্ভে চাপ মুক্ত করেছে এমন ভাবার অবকাশ নেই বরং ধীরে ধীরে চাপ বাড়ছে। যেকোনো সময় এ ধরনের আরো ভূমিকম্প ঘটতে পারে। বাংলাদেশের ভেতর ও বাইরের মধুপুর ফল্ট, ডাউকি ফল্ট, প্লেট বাউন্ডারি, আরাকান সাবডাকশন জোন আরো বড় মাত্রার ভূ-কম্পন তৈরি করতে পারে। বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিকভাবে উষ্ণ-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থান করায় আগামী দশকগুলোতেও বড় ভূমিকম্পের ঝুঁকি থেকেইে যাবে।
 
ভূমিকম্পটি বিজ্ঞানীদের জন্য নতুন বার্তা এনে দিয়েছে এবং নীতিনির্ধারকদের সামনে ঝুঁকি কমানোর জরুরি দায়িত্ব তুলে ধরেছে।
 
ভূতাত্ত্বিক বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থলটি এমন একটি এলাকায় অবস্থিত, যেটি ইন্দো-বার্মা টেকটোনিক প্লেটের অংশভুক্ত। এটি শীতলক্ষ্যা নদীর ফল্টলাইন বরাবর সংগঠিত হয়েছে। এ থেকে অনুমান করা যায়— দেশে আগামীতেও এ মাত্রার ভূমিকম্প হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে লুকানো ফল্টগুলোর দ্রুত ম্যাপিং করে জাতীয় ভূমিকম্প ঝুঁকি মানচিত্রে গুরুত্ব সহকারে যুক্ত করা প্রয়োজন।

গত শুক্রবার সকাল ১০ টা ৩৮ মিনিটে ঢাকার অদূরে নরসিংদী জেলার মাধবদী উপজেলায় রিখটার স্কেলে এর তীব্রতা অনুভূত  হয় ৫ দশমিক ৭ মাত্রায়। ভূমিকম্পটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের সতর্কতা। ভবিষ্যতে বড় ধরনের ভূমিকম্প হলে, সেটির মোকাবিলায় এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। বর্তমানে যে বিল্ডিং কোড রয়েছে, তা অবশ্যই মেনে চলতে হবে— এমন ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলা করার জন্য। এটি অনুভূত হয়েছে ভূপৃষ্ঠের ১০ কিলোমিটার গভীরে। এ ভূমিকম্পটি বাংলাদেশের বড় ধরনের ভূমিকম্পের সতর্কবার্তা। 

নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সহযোগী অধ্যাপক  এবং সেন্টার ফর ইনফ্রাস্ট্রাকচার, রিসার্চ অ্যান্ড সার্ভিস (সিআইআরএস)-এর পরিচালক ড. মিনহাজ মোহাম্মদ শাহরিয়ার বাসস’কে বলেন,  বাংলাদেশের মানুষ গত শুক্রবারে হওয়া ভূমিকম্পে আতঙ্কিত হয়েছে। এটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের বিবেচনায় বলা যেতে পারে— বাংলাদেশে অপরিকল্পিত নগরায়ন, অধিক জনসংখ্যাসহ শিল্পকারখানা ভূমির তলদেশ ক্রমশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। সে কারণে সরকারসহ সবাইকে জনসচেতনতার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মো. বদরুদ্দোজা মিয়া  বলেন, এ ধরনের ভূমিকম্প নিয়ে প্যানিক হওয়া যাবে না। জনসাধারণকে সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। অন্যদিকে স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভূমিকম্প বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।

তিনি আরো বলেন, অপরিকল্পিত নগরায়নসহ নানা কারণে বাংলাদেশ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। সে কারণে সচেতনতার চর্চা বাড়াতে হবে। নির্দিষ্ট বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি-ঘর নির্মাণ করতে হবে। ভূমিকম্প বিষয়ে গবেষণার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। ভয় নয়, পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে নিজেদের গড়ে তোলার বিষয়ে আরো মনোযোগী হতে হবে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বার কাউন্সিলের রিভিউ ফলাফল বাতিল করে উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের সিদ্ধান্ত: ২৯ নভেম্বরের এমসিকিউ পরীক্ষা স্থগিত
বাংলাদেশের নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী ভুটান : মির্জা ফখরুল
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা কৃষকদলের ১৩১ সদস্যের কমিটি : বাকেরগঞ্জের সভাপতি জাহাঙ্গীরকে অব্যাহতি
দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানির অভিযোগে তিন প্রতিষ্ঠানে দুদকের অভিযান
মার্কিন পরিকল্পনায় ‘ইউক্রেনীয় দৃষ্টিভঙ্গি’ থাকতে পারে: জেলেনস্কি
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইউক্রেনের ‘কোনো কৃতজ্ঞতাবোধ নেই’: ট্রাম্প
ঢাবি কিশোরগঞ্জ জেলা ছাত্র ঐক্য পরিষদের নবীনবরণ ও কৃতী শিক্ষার্থী সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত
হবিগঞ্জে দুদকের গণশুনানি সোমবার
ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিএনপি প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ
হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া
১০