ঢাকার সকাল : প্রশান্তির এক ভিন্ন রূপ

বাসস
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬:৩৮
ছবি : বাসস

মাহামুদুর রহমান নাযীদ

ঢাকা, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : সকালের ঢাকা যেন এক অচেনা শহর। দিনভর যানজট, গাড়ির হর্ন ও ধুলোর মধ্যে থাকা প্রাচীন শহরটির সকাল দেখা দেয় এক ভিন্ন রূপে। শান্ত আর নির্মলতায় ভরা থাকে চারিদিক। রাস্তায় থাকে না তেমন কোনো গাড়ি বা কোলাহল। বলতে গেলে, হাতেগোনা কয়েকটি ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস দেখা যায় রাস্তায়। 

সূর্য দিনভর উত্তাপ ছড়ালেও সকালের  বাতাসে মিশে থাকে হালকা শীতলতা। এই সময় রাজধানীর পার্কগুলোয় নানা বয়সী মানুষের হাঁটাচলা, দৌড়ঝাঁপ আর শরীরচর্চার দৃশ্য চোখে পড়ে। পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে শুরু করে ধূপখোলা মাঠ,লালবাগ কেল্লা রমনা পার্ক, ধানমন্ডি লেক সবখানেই মানুষের আনাগোনায় শুরু হয় প্রশান্তিময় এক ভোরের।

বাহাদুর শাহ পার্ক (ভিক্টোরিয়া পার্ক) 

ঢাকার ইতিহাসের সাক্ষী বাহাদুর শাহ পার্ক। পুরান ঢাকার প্রবীণদের স্মৃতির নানা গল্পের সাক্ষীও এই পার্ক। ভোর পাঁচটা বাজতেই এখানে মানুষের ভিড় জমতে শুরু করে। কেউ হাঁটার জুতো পরে ছন্দ মেলাচ্ছেন, কেউবা ধীরে ধীরে গাছতলায় বসে শরীরচর্চার কসরত করছেন। শুধু পুরুষ নয়, নারীদের উপস্থিতিও কম নয়। কেউ পার্কের চারপাশে বৃত্তাকারে দৌড়াচ্ছেন কেউ বা আবার সম্মিলিত ভাবে নানা ধরনের ব্যায়াম করছেন।

পুরান ঢাকার স্থানীয় বাসিন্দা মো. লোকমান হোসেন ডায়াবেটিসের রোগী। বয়সের ছাপ তার চোখে মুখে। চাকরি ছেড়ে এখন অবসরে তিনি। তার সাথে কথা হয় বাসসের। তিনি বলেন, ‘ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে অনেকদিন আগে। ডাক্তার পরামর্শ দিয়েছেন সকাল-বিকাল নিয়ম করে হাঁটাহাঁটি করতে। আমার বাসা থেকে বেশি দূরে নয় ভিক্টোরিয়া পার্ক। সকাল বেলা নামাজ পড়ে চলে আসি এখানে। আমার কিছু বন্ধুরা আসে। সবাই একই কারণে এখানে আসেন। সকালবেলা বাতাসটা ভালো থাকে, হাঁটতেও ভালো লাগে।’

পুরান ঢাকার স্থানীয় ব্যবসায়ী আবদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন ভোরে আমি ভিক্টোরিয়া পার্কে আসি। এখানে না হাঁটলে মনে হয় দিনটাই যেন কেমন হয়ে যায়। পুরান ঢাকা এখন ধোঁয়া, ধুলো আর যানজটে ভরে গেছে। কিন্তু এই পার্কে ঢুকলে মনে হয় একটু এগুলো থেকে শান্তি পাবো। বিকেলে পাখির ডাক, গাছের ছায়া, পরিচিতদের সঙ্গে দেখা হয়, আড্ডা হয়, এগুলোই এখন ভালো লাগে। মোটামুটি নিয়মিত এখানে হাঁটতে পারি বলে এখনো শরীরটা ভালো আছে।

পার্কে শুধু বয়স্করাই নন, তরুণ-তরুণী ও নারীরাও আসেন। তাদের কাছেও পার্ক সমান প্রিয়। সকালবেলা কিংবা বিকেলে ব্যায়াম করতে আসে এখানকার স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তরুণরা নিয়মিত শরীরচর্চা করে ফিটনেস ধরে রাখার চেষ্টা করেন। নারীরা দলবদ্ধভাবে হাঁটাহাঁটি করে শরীরচর্চা করেন এখানে।

ধূপখোলা মাঠ 

পুরান ঢাকার সবচেয়ে বড় খোলা জায়গাগুলোর একটি ধূপখোলা মাঠ। একসময় এখানে ক্রিকেট, ফুটবল প্রতিযোগিতা হতো, এখনো সেগুলো হয়। তবে ভোরবেলা এই মাঠ অন্যরকম এক চেহারা নেয়। চারপাশের অলি-গলির বাসিন্দারা সকালের দিকে পরিবার নিয়ে হাঁটতে আসেন সবুজ ঘাসে। বাচ্চারা খেলায় মেতে ওঠে এবং তরুণ, নারী ও প্রবীণরা সারি বেঁধে হাঁটেন। তরুণরা কেউ ব্যায়াম করেন, কেউ আবার দৌড়ঝাঁপ করে নিজের শরীর ঠিক রাখেন।

মাঠে হাঁটতে আসা শিক্ষিকা রেহানা বেগম বলেন, ‘সকালে প্রায়ই সময় এখানে আসি। আগে অনেক সুন্দর ঘাস ছিলো, তখন খালি পায়ে হাঁটতে ভালো লাগতো। আগে বাসা থেকে আমরা চারজন নিয়মিত আসতাম এখানে হাঁটতে, এখন ব্যস্ততার জন্য অনেকেই আসে না। আমি চেষ্টা করি নিয়মিত হাঁটাহাঁটি করতে।’

স্থানীয় ব্যবসায়ী মো. শহীদুল আলম বলেন, ‘আমার বয়স হয়েছে, ডাক্তারও বলেছেন নিয়মিত হাঁটার কথা। তাই প্রতিদিন সকালে ধূপখোলা মাঠে হাঁটতে আসি। হাঁটা শেষ করে বন্ধুদের সঙ্গে চায়ের আড্ডা দেই। এখানকার পরিবেশও ভালো। এতে শরীর যেমন ভালো থাকে, তেমনি মনও ভালো থাকে।’

রমনা পার্ক

রমনা পার্ক ঢাকার অন্যতম প্রাচীন এবং প্রসিদ্ধ উদ্যান। ইতিহাস, রাজনীতি, সংস্কৃতি সবকিছুর সাক্ষী এই পার্ক। সকাল-বিকালে ভরে ওঠে হাঁটতে আসা মানুষের ভিড়ে। রমনার ভেতরকার লেকের ধারে দৌড়ানো তরুণরা যেমন আছেন, তেমনি প্রবীণরাও ধীরে ধীরে হেঁটে যান গাছের ছায়ার নিচে। অনেকেই যোগব্যায়াম করেন, কেউবা শুধু নিঃশব্দে বসে থাকেন।

ঢাকার ব্যস্ত জীবনে এই পার্ক যেন মানুষের মানসিক প্রশান্তির এক অনন্য জায়গা। প্রতিদিন এখানে শতশত মানুষ এসে শরীরচর্চা করেন, স্বাস্থ্য রক্ষা করেন এবং তারা কয়েক মুহূর্তের জন্য হলেও শহরের কোলাহল থেকে দূরে থাকতে পারেন।

সরকারি চাকুরীজীবী তানভীর আহমেদ বলেন, ‘অফিসের কাজের কারণে বসে থাকতে হয় অনেকটা সময়। তাই সকালে রমনা পার্কে দৌড়াই। এতে শরীর ফিট থাকে, আর দিন শুরু করার আগেই একটা ফ্রেশ অনুভূতি পাই।’

রমনা এলাকার বাসিন্দা সেলিনা আক্তার বলেন, ‘সকালবেলা হাঁটাহাঁটির উদ্দেশ্য এখানে আসা হয়। বাচ্চাদের স্কুলে দেওয়ার পর এইসময় একটু ফ্রি থাকা যায়। হাঁটাহাঁটি করলে শরীর ভালোই লাগে, তাছাড়া এখানকার পরিবেশে কিছু সময় থাকলে আলাদা একটা প্রশান্তিও পাওয়া যায়।’

ধানমন্ডি লেক

রাজধানীর কোলাহলমুখর জীবনের ফাঁকেই ধানমন্ডি লেক হয়ে উঠেছে নগরবাসীর হাঁটাচলার অন্যতম একটি কেন্দ্র। প্রতিদিন সকাল-বিকাল এখানে আসে নানা বয়সী মানুষ, কেউ শরীরচর্চার জন্য আবার কেউবা মনকে প্রশান্ত করার আশায়। চারপাশের সবুজ গাছপালা ও পানির ছায়া ঘেরা পরিবেশে হাঁটাচলা নগরজীবনে এক ভিন্ন স্বাদ এনে দেয়।

ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে আসা অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আব্দুল মজিদ বলেন,‘আমি প্রতিদিন সকাল বিকেল এখানে হাঁটতে আসি। বয়স হয়েছে, তাই হাঁটাচলাই এখন আমার বড় ব্যায়াম। এই লেকের পরিবেশ আমাকে শান্তি দেয়, শরীরও ভালো থাকে। শহরের এতো ভীড়ের মধ্যে এমন জায়গা সত্যিই আশীর্বাদ।’

ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকুরিজীবী রিয়াজ উদ্দিন বলেন ,‘আমার বাসা খুব কাছে, তাই প্রায় প্রতিদিন রাতে এক-দেড় ঘণ্টা হেঁটে যাই। সারাদিনের ব্যস্ততার পর লেকের নিরিবিলি পরিবেশ আমার মাথা ঠান্ডা করে দেয়।’

লালবাগ কেল্লা

লালবাগ কেল্লা শুধু ইতিহাস, ঐতিহ্য আর স্থাপত্যের জন্যই নয়, এটি বর্তমানে শরীরচর্চার জায়গা হিসেবেও অনেকের কাছে পরিচিত হয়ে উঠেছে। সকালে কিংবা বিকেলের শেষ দিকে দেখা যায়, স্থানীয় বাসিন্দারা সেখানে হাঁটাহাঁটি, দৌড়, যোগব্যায়াম বা হালকা শরীরচর্চা করেন। বিশাল মুক্ত প্রাঙ্গণ, সবুজ পরিবেশ আর তুলনামূলক খোলা বাতাস মানুষকে স্বস্তি দেয়। এখানে প্রতিদিন অনেক তরুণ সকালে ব্যায়াম করেন, আবার বয়স্করা হাঁটাহাঁটি করেন। 

লালবাগ কেল্লায় ব্যায়াম করতে আসা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আহম্মেদ বলেন, ‘সারাদিনের ক্লাস পরীক্ষা ও শহরের ব্যস্ত জীবনের কারণে শরীরচর্চার সময় পাওয়া যায় না। তাই আমি প্রায়ই সকালে লালবাগ কেল্লায় আসি। এখানে দৌড়ানো, ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ করলে মনটা অনেকটা ফ্রেশ হয়ে যায়। খোলা মাঠে শরীরচর্চার পরিবেশও ভালো।

সকালের রোদ বেড়ে গেলে ঢাকা আবার ফিরে যায় তার চিরচেনা কোলাহলে। তবে সকালবেলার  হাঁটা, শরীরচর্চা কিংবা কিছুক্ষণের নিরিবিলি সময় অনেকের জন্য হয়ে ওঠে সারাদিনের শক্তির খোরাক ও মানসিক প্রশান্তির উৎস।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
দুর্গাপূজা নিরাপদে উদ্‌যাপিত হবে: আইজিপি
পূজা শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে করতে সরকার বদ্ধপরিকর: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
শেখ হাসিনার অগ্রণী ব্যাংকের লকারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স সেল
গোপনে ভিডিও ধারণের দায়ে মুদি দোকানদারের এক মাসের কারাদণ্ড
কুষ্টিয়ায় ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা শিল্পীরা, ২৫০টি মন্ডপে এবার দুর্গাপূজা 
শ্রীলংকা-আফগানিস্তান ম্যাচের দিকে তাকিয়ে বাংলাদেশ
রাজশাহীতে কাটিমন আম চাষে গতি পাচ্ছে স্থানীয় অর্থনীতি
এলডিসি উত্তরণের আগে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি নিয়ে আলোচনার আহ্বান লুৎফে সিদ্দিকীর
সাফা উইমেন লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড পেলেন পারভীন মাহমুদ
ভোলায় নারী পক্ষের ‘তরুণ প্রজন্মের সফলতার গল্প’ জেলা সম্মেলন 
১০