বাসস
  ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১১:৩৯
আপডেট : ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৩:১৫

ডান চোখ চিরতরে নষ্ট গুলিবিদ্ধ আশরাফুলের

॥ রোস্তম আলী মন্ডল ॥
দিনাজপুর, ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ( বাসস): দিনাজপুরে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীদের ছোঁড়া গুলিতে পরিবহন শ্রমিক আশরাফুল ইসলামের ডান চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। বাম চোখও নষ্ট হওয়ার পথে। কারণ, বাম চোখের নিচে এখনও গুলি রয়ে গেছে।
তার বাম চোখ ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম। এছাড়া আশরাফুলের শরীর থেকে ৭টি স্টিল বুলেট অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করা হয়েছে। এখনো তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে প্রায় ১৪ টি স্টিল বুলেট রয়ে গেছে। এই বুলেট গুলো বের করা সম্ভব হচ্ছে না বলে চিকিৎসকরা তার পরিবারকে  জানিয়েছেন।
দিনাজপুর পৌরসভার ৭ নং ওয়ার্ডের উত্তর শেখপুরা মহল্লার দিন মজুর আক্কাস আলীর পুত্র পরিবহন শ্রমিক আশরাফুল ইসলাম(৩৪) তার বাসায় কান্না জড়িত কন্ঠে কথাগুলো বলছিলেন।
তিনি বলেন, আমি একজন পরিবহন শ্রমিক হিসেবে ভাড়ায় মাইক্রো ও কার চালকের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করি। গত ৪ আগস্ট দুপুরে শহরের সি এন্ড বি কার্যালয়ের পাশে রেন্ট -এ কারের চালকেরা ভাড়ায় গ্রাহক ধরার জন্য অবস্থান করেন। হঠাৎ করে গুলির শব্দ শুনে আমি সহ অনেকেই দৌড় দিয়ে শহরের  কাচারি মোড়ে যাই। সেখান থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে তাদের বিক্ষোভ সমাবেশে আমি সহ আমার সহযোগীরাও যোগ দেই। এ সময় অতর্কিত আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সহ তাদের সন্ত্রাসী বাহিনীরা অস্ত্র হাতে লাঠি সোটা নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ জনতার ওপর হামলা চালায়। তাদের হামলায় বিক্ষোভ কারীরা বিভিন্ন দিকে ছোটাছুটি করতে থাকে। আমি দৌড় দিয়ে আত্মরক্ষার্থে দিনাজপুর সদর জেনারেল হাসপাতালের দিকে চলে যাই। হাসপাতালের গেট পর্যন্ত যাওয়ার পর আমি বুঝতে পারি আমার শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুলি লেগেছে। আমার শরীর থেকে রক্ত ঝরছে। আমি হাসপাতালের মধ্যে গিয়ে পড়ে যাই। এ সময়ে শতাধিক আহতের আর্তনাদে বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। আমি ওই হাসপাতালের মধ্যে মাটিতে পড়ে থাকার দীর্ঘক্ষণ পর আমাকে কয়েকজন উদ্ধার করে জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। এখান থেকে আমাকে দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য চিকিৎসক পরামর্শ দেন। এরপর আমাকে একটি ভ্যানে করে কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবি দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওইদিন বিকেলে  নিয়ে যায়। আমার আহত হওয়ার খবর পেয়ে আমার মা রাশেদা খাতুন ও বাবা আক্কাস আলী এবং স্ত্রী শামিমা বেগম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছুটে আসে। তারা আমার শরীরের রক্তাক্ত এই অবস্থা দেখে হাউ মাউ করে কাঁদতে থাকে।  আমার শরীরে বিদ্ধ হওয়া গুলির ব্যথায় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে এক পর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। পরদিন সকালে আমার জ্ঞান ফিরলে, আমি দেখতে পারি আমার মায়ের কোলে আমি মাথা রেখে হাসপাতালে বেডে শুয়ে আছি। আমার মুখ চোখ ফুলে গেছে। পুরো শরীরে অসহ্য ব্যথা।
এরমধ্যে একজন চিকিৎসক আমার মাকে বলেন,  আমাকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে যেতে। আমার মা বলেন, ‘আমার ছেলের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় গুলি লেগেছে, আপনারা চিকিৎসা দেন’। চিকিৎসক বলেন, ‘এখানে কোন চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, আপনার ছেলের চোখে আঘাত লেগেছে। চক্ষু হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা করেন।’


তার মা জানায়, গত ৬ আগস্ট  দিনাজপুর গাউসুল আযম চক্ষু হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তার ওয়াহিদা খানমের নিকট আশরাফুল আহত চোখের প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। তিনি পরামর্শ দেন, ঢাকা আই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য। গত ১০ আগস্ট ঢাকা মালিবাগ বাংলাদেশ আই হাসপাতালে আহত আশরাফুলকে তার মা ভর্তি করে দেন। ওই হাসপাতালে চিকিৎসক বলেন, তার চোখের অপারেশন করতে অনেক টাকা লাগবে। তার মাকে টাকা জোগাড় করতে বলেন। আশরাফুলকে রেখে তার মা পুনরায় দিনাজপুর আসেন, টাকা সংগ্রহের জন্য। তাদের বাসায় থাকা দুটি গরু ছিল, গরু দুটি এক লাখ ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করে, তার মা রাশেদা বেগম পুনরায় ঢাকায় যান।
আই হাসপাতালে চিকিৎসক তার মাকে বলেন,  বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আহত রোগীদের ফ্রি চিকিৎসার ব্যবস্থা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে করেছেন। আহত আশরাফুলকে ওইদিন ২৪ আগস্ট আই হাসপাতালের চিকিৎসক তাকে ছাড়পত্র দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য পরামর্শ দেন ।
আশরাফুলের মা রাশেদা বেগম তার আহত সন্তান আশরাফুলকে নিয়ে ওই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে সন্ধ্যার পর পৌঁছেন। কিন্তু ওই সময় ওই হাসপাতলে তার ছেলেকে ভর্তি করার মত কোন অবস্থা ছিল না। পরদিন ২৫  আগস্ট  আশরাফুলের চিকিৎসার কাগজপত্র দেখে তাকে এই হাসপাতালের চতুর্থ তলার চক্ষু বিভাগের ওয়ার্ডে ভর্তি করানো হয়।
আশরাফুলের মা রাশেদা বেগম বলেন, ভর্তি হওয়ার তিন দিন পর অনেক চেষ্টা করে এই হাসপাতালের পরিচালকের সহযোগিতায় তার ছেলে আশরাফুলের ডান চোখে অস্ত্রোপচার করেন চক্ষু বিভাগের অধ্যাপক ডাক্তার সেলিম রেজা। অস্ত্রোপচারের পর ডাক্তার তাদের বলেন, তার ডান চোখ আর ভালো হবে না, চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে। বাম চোখের চিকিৎসা করানো হবে, তবে ভালো হওয়ার সম্ভাবনা কম রয়েছে। তারা চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ২৪ দিন থাকার পর আশরাফুলকে গত ২৮ সেপ্টেম্বর রিলিজ দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসক বলেছেন, চোখের ড্রপ দেওয়া হয়েছে। সে সাথে তার শরীরে থাকা গুলিগুলো অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে বের করার জন্য খাওয়ার ওষুধ দেওয়া হয়েছে। ওষুধ গুলো নিয়মিত খেয়ে আগামী একমাস পর হাসপাতালে এসে, এমআরআই পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে, চিকিৎসকের সাথে দেখা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
আশরাফুল জানান,  তার শরীরে ২১টি গুলির মধ্যে ৭টি গুলি বের করা হয়েছে। গত ৭৪ দিন যাবত শরীরে ১৪ টি গুলি নিয়ে মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েও ভয়াবহ কষ্টে তার দিন কাটছে। রাতে ঠিকমত ঘুমাতে পারেন না, দিনের বেলায় শরীরের ব্যথায় ছটফট করতে থাকেন। তার সার্বক্ষণিক সেবায় কাজ করে যাচ্ছেন স্ত্রী শামিমা বেগম ও মা রাশেদা বেগম।
তার স্ত্রী শামিমা বেগম বলেন, তাদের দুটি সন্তান রয়েছে, বড় মেয়ে জান্নাতুন্নেসার পাঁচ বছর বয়স, ছোট ছেলে সিয়াম বাবু কেবল দু'বছর অতিক্রম করেছে। তার আহত স্বামী আশরাফুল, দুটি নাবালক ছেলে ও মেয়ে, বৃদ্ধ  শ^শুর আক্কাস আলী, শ^াশুড়ি রাশেদা বেগম ও নয় বছর বয়সের দেবর মোহাম্মাদ আলীকে  নিয়ে তাদের সংসার। একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি তার স্বামী আশাফুল ইসলাম গত ৭৪ দিন যাবত গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শয্যাশায়ী হয়ে আছেন। তার শ^শুর আক্কাস আলী বৃদ্ধ বয়সে দিনমজুরের কাজ করে যেটুকু রোজগার হয় তা দিয়েই কোন  রকমে সংসার চালাচ্ছেন। চিকিৎসা বাবদ নিকট আত্মীয়দের কাছ থেকে কিছু সহযোগিতা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কোন রাজনৈতিক দল বা সরকারের পক্ষ থেকে কোন আর্থিক সহযোগিতা পাওয়া যায়নি। তার স্বামীর খোঁজ খবর নেওয়ার জন্য কেউ আসেনি। তিনি বলেন, আমার অসহায় স্বামীর ওপর যারা নির্মমভাবে গুলি চালিয়েছেন তাদের সঠিক বিচার করতে হবে। তিনি বর্তমান অন্তবর্তী কালীন সরকারের কাছে এ দাবি করেন।
আশরাফুলের মা রাশেদা খাতুন বলেন, পুত্রের আহত হওয়ার ঘটনায় তিনি নিজে  বাদী হয়ে গত ২৬ সেপ্টেম্বর  কোতয়ালী থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, সাবেক হুইপ ইকবাল রহিম সহ ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে  এবং অজ্ঞাতনামা ৩৫০ জনকে আসামী করে  নাশকতা ও হত্যার চেষ্টার অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করেছেন।
তিনি বলেন, মামলা করার পর থেকে বিভিন্ন অজ্ঞাত মোবাইল নম্বর থেকে তাকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। তিনি এসব বিষয় কোতোয়ালী থানার পুলিশ অফিসারকে বলেছেন।
তারা হুমকি দেওয়া মোবাইল নাম্বারগুলো রেখে দিয়েছেন বলে জানান।
দিনাজপুর সদর কোতয়ালী থানার অফিসার ইনচার্জ পরিদর্শক মোঃ ফরিদ হোসেন জানান,   গত ২৬ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১১ টায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুরুতর আহত আশরাফুল ইসলামের মাতা মোছাঃ রাশেদা খাতুন বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী  আসাদুজ্জামান কামাল সহ ৮৪ জনের নাম উল্লেখ করে কোতয়ালী থানায় হত্যা চেষ্টা ও নাশকতার ঘটনার বর্ণনা দিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
আশরাফুলের মা রাশেদা বেগম কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমার পুত্র আশরাফুলের ডান চোখ চিরতরে নষ্ট হয়ে গেছে এবং বাম চোখও অন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। গুরুতর আহত ছেলের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করতে করতে নিঃস্ব হয়ে গেছি।
আমার ছেলের চোখের এবং শরীরে বিভিন্ন স্থানের গুলি বের করতে না পারার কারণে সে এখন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। আমার আশঙ্কা, ছেলে যে কোন সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে পারে। আই তার সুচিকিৎসায় বর্তমান অন্তবর্তী কালীন সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।
আশরাফুলের বাবা আক্কাস আলী বলেন, নির্মম ভাবে যাদের হুকুমে তার নিরপরাধ পুত্রের ওপর গুলি করা হয়েছে, তিনি তাদের বিচার দাবি করেন।