শিরোনাম
প্রতিবেদক: আসাদুজ্জামান
সাতক্ষীরা, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার পতনের পর আনন্দ মিছিলে যোগ দেন মেধাবী ছাত্র আমান উল্লাহ। তিনি সাতক্ষীরার আশাশুনির প্রতাপনগর গ্রামের।
স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা ও তার দোসররা আনন্দ মিছিলে গুলি ছুঁড়লে গুরুতর আহত হন তিনি। তার পেটে, বুকে ও ডান হাতের কাঁধে তিন জায়গায় তিনটি গুলি বিদ্ধ হয়। এতে তার পেটের ৫ টি নাড়ী ছিদ্র হয়ে যায়। দীর্ঘদিন চিকিৎসা নিয়েও এখনও তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
লেখাপড়া শেষ করে দিনমজুর বাবার ছেলে আমান উল্লাহ কলেজ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু সে স্বপ্ন আজ অনেকটা নিরাশায় পরিণত হতে চলেছে।
আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের দরিদ্র দিনমজুর আমজাদ আলী সরদারের (৬৫) পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট আমান উল্লাহ (২৫)। তিনি খুলনা খালিশপুর হাজী মোহাম্মদ মুহসিন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র। একই সাথে তিনি একই জেলার কয়রা উপজেলার উত্তরচক বহুমুখী কামিল মাদ্রাসার কামিল শেষ বর্ষের ছাত্র। আমান উল্লাহর মায়ের নাম আনোয়ারা খাতুন (৫০)। তিনি পেশায় একজন গৃহিণী। তার বড় বোন লিপিয়া খাতুন (৩৫)। বিবাহিতা এই বোন থাকেন তার শ্বশুর বাড়িতে। মেজ বোন আসমা খাতুন (৩২)। তার স্বামী মারা যাওয়ায় তিনি তার তিন সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকেন। সেজো বোন সানজিদা খাতুন (৩০) ও তার পরের বোন নাসরিন নাহার (২৮)। তারা দুজনই থাকেন তাদের শ্বশুর বাড়িতে।
গুলিবিদ্ধ গুরুতর আহত আমান উল্লাহ জানান, গত ৫ আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর বিকেলে আনন্দ মিছিলে যান তিনিসহ অসংখ্য মানুষ। মিছিলটি প্রতাপনগর ইউনিয়নের তালতলা বাজার থেকে বের হয়ে ফুলতলা বাজার ও কল্যাণপুর বাজার হয়ে নাকনা গ্রামের স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের বাড়ির সামনে দিয়ে যায়। এ সময়ে জাকির ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী শান্তিপূর্ণ আনন্দ মিছিলকে লক্ষ্য করে অনবরত গুলি ছোঁড়ে।
আমান উল্লাহর শরীরে মোট তিনটা গুলি লাগে। এর মধ্যে একটি তার পেটের ভেতরে ঢুকে পাঁচটি নাড়ি ছিদ্র করে ফেলে। আরেকটি গুলি তার বুকের ঠিক হার্টের দুই ইঞ্চি উপর দিয়ে ঢুকে অপর পাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। আরেকটি গুলি তার ডান হাতের বাহুতে লাগে। এতে তিনি গুরুতর জখম হন। এ সময় স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন। সেখানে চিকিৎসকরা অপারেশন করে তিনটি গুলি বের করেন। মেডিকেল কলেজের আইসিইউতে তিনি ৮ দিন লাইফ সাপোর্টে ছিলেন। এরপর কিছুটা সুস্থ হলে তাকে বেডে নেয়া হয়। সেখানে তিনি এক মাসেরও বেশি সময় চিকিৎসা নেন।
তবে, চিকিৎসকরা বলেছেন, দুই মাস পর আবারো তার পেটে আরো একটি অপারেশন করতে হবে। এ নিয়ে তিনি খুব দুঃশ্চিন্তায় রয়েছেন। দিনমজুর বাবা অনেক কষ্ট করে তার গচ্ছিত সকল টাকা পয়সা খরচ করে চিকিৎসা করিয়েছেন। তার ওপর আবারো আর একটা অপারেশন করতে হলে এই টাকা কোথায় পাবেন তিনি?
তিনি আরো বলেন, ‘লেখাপড়া শেষ করে কলেজ শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখছিলাম। কিন্তু সে স্বপ্ন নিরাশায় পরিণত হতে হচ্ছে। কারণ এখনও সম্পূর্ণ সুস্থ হতে পারিনি। এখনও ব্যথা বেদনা আর যন্ত্রণা নিয়ে চলাফেরা করতে হচ্ছে।
তিনি তার সুস্থতার জন্য সকলের কাছে দোয়া চান।
আমান উল্লাহর মা আনোয়ারা খাতুন বলেন, ‘ছেলে আমার বাড়ি থেকে যখন বেরিয়েছে তখন সুস্থ ও সবল ছিল। হঠাৎ করেই বিকেলে খবর আসলো আমার ছেলে খুবই অসুস্থ। তার পেটে ও বুকে গুলি লেগেছে। খবর শুনেই ছুটে গেলাম তার কাছে। তাকে নিয়ে গেলাম সাতক্ষীরায়। যেভাবে সে রক্তাক্ত ও জখম হয়েছে। তার তো বাঁচার কথা না। মহান আল্লাহপাকই তাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।’
তিনি এ সময় আক্ষেপ করে বলেন, অনেক কষ্ট করে ছেলেটার লেখাপড়া শেখানো হচ্ছে। ওর বাবা দিনমজুরের কাজ করে আমাদের সংসার চালায়। আর্থিক অবস্থাও ভালো না। তার ওপর ছেলের চিকিৎসায় যা কিছু ছিল সবই শেষ হয়ে গেছে। এখন আমরা নিঃস্ব হয়ে গেছি। ওকে ভালো মন্দ খেতেও দিতে পারি না।
আমান উল্লাহর বাবা দিনমজুর আমজাদ আলী সরদার বলেন, পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট আদরের একমাত্র ছেলে আমার আমান উল্লাহ। তাকে নিয়ে অনেক আশা ছিল।
ছেলে আমার লেখাপড়া শিখে ভালো একটা চাকুরি করবে এবং সংসারের হাল ধরবে। কিন্তু কি যে হয়ে গেলো। ছেলে আমার যন্ত্রণার ক্ষত নিয়ে এখন চলাফেরা করছে। মাঝে মধ্যে ব্যথা বেড়ে গেলে ছটফট করে, তখন ওর মুখের দিকে তাকানো যায় না। তিনি এসময় অশ্রুসিক্ত নয়নে জানান, ওর চিকিৎসার পেছনে আমার সব শেষ হয়ে গেছে।
এখন আমি নিঃস্ব। আমার কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। সরকারি-বেসরকারি তেমন কোন অনুদানও পাইনি। এখন কিভাবে চলবো তাই ভাবছি।
তিনি এ সময় তার সন্তানের সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চেয়েছেন।