বাসস
  ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:০৭

‘খুনিরা স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুমায়, আমি বুকের ধন হারিয়ে বিচারের দাবিতে রাস্তায় ঘুরি’ এ ক্ষোভ শহিদ সাব্বিরের পিতার

প্রতিবেদন : আব্বাছ হোসেন

লক্ষ্মীপুর, ২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : কলেজে যাওয়ার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়েছিলেন সাব্বির। কিন্তু আর বাড়ি ফেরেননি তিনি। শেষমেশ ঠিকই বাড়িতে ফিরেছেন। তবে বুকের ভিতর ৭টা গুলি আর নিথর দেহ নিয়ে। 

সাব্বির হোসেন (২০) দালাল বাজার ডিগ্রি কলেজের একাদশ  দ্বিতীয় বর্ষে অধ্যায়নরত ছিলেন। দেশজুড়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সাব্বির হোসেন নিজেকে সে আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে পারেননি। গত ৪ আগষ্ট সকালে কলেজে না গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলে যান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে। হঠাৎ আন্দোলনকারীদের ওপর যুবলীগের হামলা হয়।

এক পর্যায়ে গুলি চালানো হয় শিক্ষার্থীদের ওপর। এক সহপাঠীকে বাঁচাতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন সাব্বির হোসেন। সঙ্গে সঙ্গে লুটিয়ে পড়েন তিনি। ঘটনাটি লক্ষ্মীপুর শহরের তমিজ মাকের্ট এলাকায় সাবেক যুবলীগের সভাপতি সালাউদ্দিন টিপুর বাসভবনের নিচের। এরপর আর উঠে দাঁড়াতে পারেননি সাব্বির। সবার চোখের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন তিনি। এমন মৃত্যুতে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ে তার সহপাঠী ও তৎকালীন আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীরা। 

এদিকে সাব্বির হোসেনের শোকার্ত বাবা-মায়ের আর্তনাদ যেন এখনো থামছেই না। খুনিদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বৃদ্ধ বাবা আমির হোসেন। কবে ছেলে হত্যার বিচার দেখে যেতে পারবেন, সে আশায় এখনও বুক বেধেঁ আছেন তিনি।

সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জের শরীফপুর এলাকার হতদরিদ্র বৃদ্ধ আমির হোসেন ও মায়া বেগমের ছেলে শহিদ সাব্বির হোসেন। তিন ভাই বোনের মধ্যে বড় ছিলেন সাব্বির। ছোট দুই বোন। শ্রাবন্তি বেগম এইচএসসি ও অহনা বেগম ভবানীগঞ্জ মাদ্রাসার ৪র্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী। এছাড়া প্রায় দুই বছর আগে সাব্বির হোসেন নিজের পছন্দে বিয়ে করেন। তার স্ত্রীর নাম তন্না বেগম। তাদের ঘরে রয়েছে তাহসিন আক্তার নামে তের মাসের এক কন্যা শিশু। 

শহিদ সাব্বির হোসেনের বাবা চট্ট্রগ্রাম বন্দরে লোড-আনলোডের শ্রমিকের কাজ করতেন। এই দিয়ে চলতো ছেলে-মেয়ের লেখাপড়া ও সংসার।

সম্প্রতি সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, শহিদ সাব্বির হোসেনের বৃদ্ধ বাবা আমির হোসেন ও মা মায়া বেগম ঘরের সামনে বসে স্বজন জুয়েল হোসেনের সাথে কথা বলছেন। এ সময় সাব্বির হোসেনকে নিয়ে দুইজনকে কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। এক পর্যায়ে মা মায়া বেগম জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে তিনি আহাজারি শুরু করেন। তার আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে বাতাস। 

এদিকে ছেলে হত্যার সাথে জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচারের দাবিতে ছেলের ছবি বুকে নিয়ে আর্তনাদ করতে দেখা যায় সাব্বির হোসেনের বাবাকে।

এ সময় কথা হয় শহিদ সাব্বির হোসেনের বাবা আমির হোসেন ও মামা জুয়েল হোসেনের সাথে। 

তারা জানান, জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা সহযোগিতা পেয়েছেন তারা। এছাড়া সরকারিভাবে এখনো কোন সহায়তা পাননি। 

তবে আক্ষেপ করে সাব্বির হোসেনের বাবা আমির হোসেন বলেন, দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হয়েছে। এতে কিছুটা  স্বস্তি পেলেও ছেলে হারানোর ব্যথা কি ভুলা যায়? দেশ দ্বিতীয়বার স্বাধীন হওয়ার পাঁচমাস হতে চলেছে। এখনো খুনিরা ধরা পড়েনি। তারা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ঘুমায়। আনন্দ উল্লাস করে। 

আর আমি আমার বুকের ধনকে হারিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিচার চেয়ে ঘুরছি, এই বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।

প্রত্যক্ষদর্শী ও শিক্ষার্থীরা জানায়, গত ৪ আগষ্ট, বেলা ১১টা। সারাদেশের মতো বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচিতে উত্তাল ছিল পুরো লক্ষ্মীপুর। মিছিলে মিছিলে মুখরিত ছিল সারা শহর। হঠাৎ আওয়ামীলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা উত্তর তেমুহানী থেকে একটি মিছিল নিয়ে ঝুমুর চত্ত্বরের দিকে যাচ্ছিলো। এসময় ছাত্র আন্দোলকারীদের মিছিলের ওপর হামলা চালানো হয়। পাল্টা প্রতিরোধের চেষ্টা করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীরা। এ সময় জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি ও সদর উপজেলা পরিষদের অপসারনকৃত চেয়ারম্যান একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে অনবরত গুলি ছোঁড়ে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

এর জের ধরে ফুঁসে উঠে শিক্ষার্থীরা। মিছিল নিয়ে বাজারের দিকে এগুতে থাকে তারা। শহরের তমিজ মার্কেট এলাকায় পৌঁছালে নিজ বাসভবনের ছাদ থেকে প্রকাশ্যেই সালাউদ্দিন টিপু ও তার সহযোগিরা শিক্ষার্থীদের ওপর এলোপাতাড়ি গুলি ছোঁড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে এইচএসসি পরীক্ষার্থী সাল আল আফনান, কাউছার উদ্দিন বিজয় ও তৌহিদ কবির রাফি এবং সাব্বির হোসেন মারা যায়। এ সময় তিন শতাধিক গুলিবিদ্ধসহ আহত হয় কমপক্ষে ৫শ’র বেশি শিক্ষার্থী।

এ ঘটনায় পৃথক তিনটি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। টিপু ও জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহিন আলমের শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি করার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হয়।  এসব ঘটনায় অপসারণ করা লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি একেএম সালাহ উদ্দিন টিপুকে প্রধান এবং সাবেক পৌর মেয়র মোজাম্মেল হায়দার মাসুম ভূঁইয়াসহ ৭৫ জনের নাম উল্লেখ করে ও আরো ৭শ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে শহিদ সাব্বির হোসেনের বাবা আমির হোসেন বাদী হয়ে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এতে আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠনের পধদারী নেতাদের নামও রয়েছে। 

এদিকে আসামিরা আত্মগোপনে থেকে মামলার বাদী ও স্বজনদের বিভিন্ন ভয়ভীতি ও হত্যার হুমকি দিয়ে বেড়াচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। 

জড়িতদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান নিহতের স্বজন ও সহপাঠিরা।

জেলা জামায়াতের সহ-সেক্রেটারী এডভোকেট মহসিন কবির মুরাদ বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রকাশ্যে যুবলীগ নেতা সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি ছুঁড়েছে, ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে স্বৈরাশাসক শেখ হাসিনার নির্দেশে পাখির মতো ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করেছে। জামায়াত ইসলামী শহিদ ও আহতদের পাশে দাঁড়িয়েছে। ভবিষ্যতেও থাকবে।

পুলিশ সুপার মো. আকতার হোসেন বলেন, যারা শিক্ষার্থীদের গুলি করে হত্যা করেছে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকি আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না।

জেলা প্রশাসক রাজিব কুমার সরকার বলেন, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে চার শিক্ষার্থী শহিদ হয়েছেন। এছাড়া জেলার বাইরে আরো ১৩জন শহিদ হন।  ২৭১ জন আহত হয়েছেন। তাদের তালিকা করা হয়েছে। সেটা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তারা যেন যথাযোগ্য মর্যাদা পায়, প্রশাসনের পক্ষ থেকে সকল ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শহিদ ও আহত অনেককেই আর্থিক অনুদান দেয়া হয়েছে।

এদিকে লক্ষ্মীপুর-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব শহীদ উদ্দিন এ্যানী বলেন, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সন্ত্রাসী একেএম সালাউদ্দিন টিপুর নেতৃত্বে যেভাবে অবৈধ অস্ত্র দিয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালিয়ে চার শিক্ষার্থীকে হত্যা করা হয়েছে তা নজিরবিহীন। শহিদ ও আহতদের পাশে বিএনপি রয়েছে। সব সময় থাকবে।  জড়িতদের যেন দ্রুত আইনের আওতায় আনা যায়, সেইদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দৃষ্টি দেয়ার আহবান জানান তিনি। 

হত্যাকারীদের বিচার হবেই হবে। কোনভাবেই তাদের ছাড় দেয়া হবে না বলে উল্লেখ করেন তিনি।