শিরোনাম
প্রতিবেদন : মো. এনামুল
পটুয়াখালী, ২৩ ডিসেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : মা তুমি কান্না করবা না। তুমি কান্না করলে তোমার চোখের পানি আমার ভালো লাগে না। কান্না করলে এসব কথা বলে মাকে সান্ত্বনা দিতেন আমিনুল ইসলাম আমিন।
এখন কলিজার টুকরো একমাত্র সন্তান হারিয়ে মা প্রতিদিন কান্না করেন ঠিকই, কিন্তু কেউ আর বলে না, ‘মা তুমি কান্না করবা না, তোমার কান্না আমার ভালো লাগে না’।
কান্নাজড়িত কন্ঠে এসব কথা বলেন শহিদ আমিনের মা সেলিনা বেগম (৪০)।
বলছিলাম পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার কেশবপুর ইউনিয়নের ভরিপাশা গ্রামের অটোরিকশাচালক মো. ওবায়দুল ইসলাম (৪৫) ও তার স্ত্রী সেলিনা বেগমের একমাত্র সন্তান শহিদ আমিনুল ইসলাম আমিনের কথা। গত ২১ জুলাই রোববার রাজধানীর যাত্রাবাড়ির দনিয়া এলাকার গোয়ালবাড়ির মোড়ে পুলিশের গুলিতে নির্মমভাবে শহিদ হন কারখানাশ্রমিক ১৬ বছর বয়সী আমিন।
শহিদ আমিনের মা সেলিনা বেগম বলেন, যাত্রাবাড়ির দনিয়া এলাকার এ কে স্কুল এ্যান্ড কলেজের পাশে ছোট একটি ভাড়া বাসায় আমরা থাকি। আমাদের একমাত্র সন্তান আমিন। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করিয়ে অভাবের তাড়নায় একটি কারখানায় চাকুরিতে দিয়েছিলাম। মাসে আট হাজার টাকা বেতন পেতো আমার ছেলে।
সেলিনা বেগম আরও বলেন, শহিদ হওয়ার দিন সকালে আমিন আমাকে বলেছিলো, মা আজ কাজে যাবো না। শরীরটা ভালো লাগছে না। পরে সারাদিন ঘুমিয়ে বিকেলে নাস্তা করার কথা বলে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
আমিন আসলে তার মাকে না জানিয়ে শনির আখড়ায় আন্দোলনে গিয়েছিলো। সেখানে আমিনসহ সাতজন পুলিশের গুলিতে আহত হয়।
তিনি বলেন, পরে আমার আমিনকে দুইজন ছাত্র অনাবিল হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানকার ডাক্তাররা তাদের ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যেতে বলেন ।
তখন ওই ছাত্ররা উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিক্যালে নিতে একটি অটোরিকশা ডাকেন। গুরুতর আহত আমিনকে রিকশায় তুলতে গিয়ে দেখেন চালক আর কেউ নন, শহিদ আমিনের বাবা ওবায়দুল ইসলাম। এ সময় ছেলেকে গুলিবিদ্ধ দেখে কান্নায় আকাশ-পাতাল ভারি করেন কিশোর আমিনের বাবা। নিয়ে যান ঢাকা মেডিক্যালে। সেখানকার ডাক্তাররা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
মসজিদ থেকে টাকা তুলে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে দাফনের উদ্দেশ্যে শহিদ আমিনকে গ্রামের বাড়ি পটুয়াখালীর বাউফলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জানাজায় অসংখ্য লোক শরিক হন। এলাকায় নেমে আসে শোকের ছায়া। আমিনের মৃত্যু মেনে নিতে পারছে না কেউ।
বাউফলের ভরিপাশায় দাদার কবরের পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহিদ আমিনুল ইসলাম আমিন।
শহিদ আমিনের মা বলেন, কারখানায় কাজের ফাঁকে ফুটবল খেলতো সে। প্রতি শুক্রবার বাড়ির পাশের মাঠে ফুটবল খেলতে যেত। খেলাধুলা করে অনেক পুরস্কারও পেয়েছিলো। ছেলের অর্জিত পুরস্কার হাতে নিয়ে চুমু খেয়ে কান্না করতে করতে আমিনের মা আরো বলেন, ‘এখন আমার আমিন নেই, কে খেলবে ফুটবল আর কে আনবে পুরস্কার? কে আমাকে মা বলে ডাকবে? আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। আমি শতকোটি টাকা চাই না। আমার ছেলেকে আমার বুকে ফেরত চাই।’
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ আমিনুল ইসলাম আমিনের পরিবারকে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত অর্থায়ন করে পাশে দাঁড়িয়েছে দুটি প্রতিষ্ঠান। জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ ৩ লাখ টাকা অর্থ সহায়তা প্রদান করেছে। আর জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে দেয়া হয়েছে ৫ লাখ টাকা।
শহিদ আমিনের প্রতিবেশী মিতু বেগম (৬০) বলেন, আন্দোলনে যাবার সময় আমিন বলেছে আমার যদি এখানে মৃত্যু হয় তাহলে আমি শহিদ হবো। আমি রাগ করেই তাকে বলেছি ওসব ঝামেলায় যাবে না। কিন্তু সে আমাকে বললো, এত টেনশন করো কেন নানী। আমার এখানে মৃত্যু হলে আমি শহিদ হবো। আমার জন্য টেনশন করবা না।
কারখানার সহকর্মী ও শহিদ আমিনের খালা নূরজাহান (৪০) বলেন, আমার সন্তানের মতো দেখেছি আমিনকে। বোনের ছেলে আর আমার ছেলে কোনো পার্থক্য নেই।
আমিনকে সব সময় মিস করি। ওর কথা মনে পড়লেই কান্না করি। আল্লাহ আমিনকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করুক। ওর হত্যাকারীদের বিচার চাই। সরকার যেন খুনিদের বিচার করে।
শহিদ আমিনের বাবা ওবায়দুল হাসান (৪৫) বলেন, একমাত্র সন্তান হারিয়ে বুকটা খালি হয়ে গেছে। আমার আদরের ধন আমিনের হত্যাকারীদের বিচার চাই। শেখ হাসিনাকে হুকুমের আসামি করে বিচারের দাবি জানাই সরকারের কাছে। যাত্রাবাড়ি থানায় ৯৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৫০ জনকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তিনি।