বাসস
  ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৪১
আপডেট : ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০১

‘বাইকটা ছুঁলেই মনে হয় আমি রাকিবকে স্পর্শ করছি’ - শহিদ রাকিবের বাবা

॥ শাহজাহান নবীন ॥

ঝিনাইদহ, ১৪ অক্টোবর ২০২৪ (বাসস): এখনও ফ্রিজে জমানো রয়েছে দুধ, গুড়, নারকেল, পুলিপিঠার পুর। নিস্তব্ধ ঘরের প্রতিটি জিনিস পরিপাটি সাজানো। টান টান করা বিছানার এক পাশে বালিশ। পড়ার টেবিলে তাকে তাকে সাজানো বই। ড্রয়িং রুমে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রিয় মোটরসাইকেল। তার পাশেই কাপড় ধোয়ার মেশিন। পানিশূন্য পানির ফিল্টারের ভেতরটা শুষ্ক, আয়রনের হালকা আস্তর।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গত ১৯ জুলাই গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ  হন মো. রাকিবুল হোসেন (২৯)। রাকিব চাকরির সুবাদে ঢাকায় থাকতেন। কিন্তু গ্রামের বাড়িতে তার ঘরটা সবসময় এমনই সাজানো থাকতো তার অপেক্ষায়। পরিপাটি ঘরটি দেখে মনে হবে খানিক পরেই ফিরবে রাকিব। একটা বাড়িতে তিনজনের বসবাস। কিন্তু কোথাও যেন কেউ নেই। নেই কোনো শব্দ। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে যে ঝরে গেছে সহস্র নক্ষত্র। তেমনই এক নক্ষত্র মো. রাকিবুল হোসেন। যে বাড়িতে বিপ্লবী নক্ষত্রের ঝরে পড়া স্মৃতি জমা থাকে, সেখানে কি আর কখনো শোরগোল জমে? রাকিব শহিদ হয়েছেন আজ ৮৩ দিন পেরিয়ে গেল। কিন্তু তার পরিবারের শোকের মাতম আজও থামেনি।

ঝিনাইদহ জেলার সদর পৌরসভার সার্কিট হাউজ রোডের মহিষাকুন্ডু গ্রামের বাসিন্দা বিমান বাহিনীর মাস্টার ওয়ারেন অফিসার (অব:) আবু বকর সিদ্দিক (৬১) এবং  হাফিজা খাতুন (৫৮) দম্পতির পুত্র  মো. রাকিবুল হোসেন বনানী সুপার জুট মিলে চাকরি করতেন। ঢাকার মিরপুরে ১১ নম্বরে ভাড়া বাসায় থাকতেন । দুই ভাইয়ের মধ্যে রাকিব ছোট। বড় ভাই  ইকবাল হোসেন (৩৭) সোনালী ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে ঝিনাইদহ শাখায় কর্মরত।

শহিদ রাকিবের বাবা আবু বকর সিদ্দিক অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বাসসকে বলেন, ‘আন্দোলনের সময় আমরা রাকিবকে ফোন করলে সে লোকজনের ভিড় থেকে সরে গিয়ে আমাদের সঙ্গে কথা বলত। সে যে আন্দোলনে অংশ নিয়েছে, এটা সে আমাদের বুঝতে দিতে চাইতো না। এসব কথা রাকিবুলের সহকর্মীরা পরে আমাদের জানিয়েছে।’

রাকিবের মা হাফিজা খাতুন বলেন, ‘১৮ জুলাই ঢাকায় যখন আন্দোলনে হামলা শুরু হয়, তখন থেকেই আমরা ভয়ে ছিলাম। শুধু ভাবতাম আমার রাকিব অফিসে যাবে কিভাবে? ১৯ জুলাই শুক্রবার রাকিবকে ফোন করে বললাম, আব্বু অফিস থেকে তাড়াতাড়ি ফেরা যাবে না? আমার আব্বুটা বলেছিল, না মা, ফেরা যাবে না।’

এ কথা বলে তার মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নিজেকে সামলে আবার বলতে শুরু করেন, ‘১৯ জুলাই, শুক্রবার, বেলা আড়াইটার পরে আমার ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়। রুটি আর ডিম ভাজি দিয়ে সকালের নাস্তা করেছিল আমার আব্বুটা।’

হাফিজা খাতুন বলেন, ১৯ জুলাই মিরপুর ১১ তে মেট্রোরেল লাইনের নিচে আন্দোলনকারীদের মাঝে আমার ছেলে পানি বিতরণ করছিল। শিক্ষার্থীদের মাঝে সে যতক্ষণ ছিল, ততক্ষণ নিরাপদেই ছিল। যখনই সে পানি বিতরণ শেষে শিক্ষার্থীদের থেকে কিছুটা আলাদা হয়ে যায়, তখনই তাকে টার্গেট করে গুলি করা হয়। আমার ছেলের সাথে থাকা সহকর্মীরা জানিয়েছে, ওপর থেকে গুলি এসে তার গলায় ঢুকে যায়। পরে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে আমার ছেলেটা মারা যায়।

শহিদ রাকিবের বাবা আবু বকর সিদ্দিক বলেন, ‘আমার ছেলের বন্ধু পিয়াস জানিয়েছে, সে সময় একজন বয়স্ক  মহিলা দৌড়ে রাস্তা পার হতে যেয়ে রাকিবের সামনে এসে পড়ে যায়। ওই সময় রাকিব তাকে টেনে তুলতে এগিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই ওপর থেকে নিখুঁত টার্গেটে আমার ছেলেকে গুলি করা হয়।’

তিনি জানান, রাকিবের বন্ধু পিয়াস প্রথম বাড়িতে খবর দেন। পিয়াসই রাকিবের অফিসের সহকর্মী  সালমান ও ফয়সালকে দিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে মৃতদেহ ঢাকা থেকে ঝিনাইদহে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। হরিণাকুন্ডু উপজেলার চাঁদপুর ইউনিয়নের বাসুদেবপুর গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে শহিদ রাকিবকে দাফন করা হয়।

রাকিবের মা বলেন, ১৯ জুলাই রাত আটটার দিকে একমাত্র ভাতিজা রাফসান (৪)-এর সাথেই রাকিবের শেষ কথা হয়। রাফসান রাকিবকে ‘ছোট আব্বু’ ডাকত। ফোনে কথা বলার সময় রাফসান রাকিবকে বলেছিল- ‘ছোট আব্বু তুমি বাড়ি চলে আসো। গাড়ি না পেলে তোমার বাইক নিয়ে চলে আসো। না হয় তুমি অ্যাম্বুলেন্সে বাড়ি চলে আসো।’ কে জানতো চার বছরের অবুঝ শিশুটির সেই কথাই এমন নির্মম বাস্তবে পরিণতি পেয়ে যাবে! রাকিব বাড়ি ফিরেছে ঠিকই। প্রিয় বাইক কিংবা গাড়িতে নয়, বরং নিথর দেহে অ্যাম্বুলেন্সে চেপেই শেষবারের মতো বাড়ি ফেরা হলো তার।

আবু বকর সিদ্দিক আবেগাপ্লুত কণ্ঠে বলেন,‘আমার ছেলে পরপারের যাত্রী হয়েছে আজ ৮৩ দিন। এই দিনগুলো কত কষ্টের তা আমরা ছাড়া আর কেউ জানে না। রাতে বিছানায় ঘুমাতে পারি না। আমার খোকার সখের মোটরসাইকেল, পড়ার টেবিল, হেলমেট, বই-পত্র দেখলেই বুক ফেটে কান্না আসে।’

রাকিবের মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন-‘আমার ছেলে কোনো রাজনীতি করতো না। সে শুধু আমাকে বলেছিল, মা ছোট ছোট ভাই-বোনেরা আন্দোলন করছে। আমরা যদি বড় ভাই হয়ে ওদের পাশে না দাঁড়াই, তাহলে ওরা সাহস পাবে কোথায়?’

রাকিব ঝোলা গুড়, নারকেল ও পুলিপিঠা পছন্দ করতো জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি ঢাকায় যাবো বলে আমার রাকিব নতুন বাসা নিয়েছিল। আমি দুধ, নারকেল, ঝোলা গুড়, আটা গুছিয়ে রেখেছিলাম। কিন্তু সেই সবকিছু তেমনই আছে। আমার বাবাটা আর নেই। এই সব খাবার আমি কি আর কোনো দিন মুখে নিতে পারব?” একথা বলেই হুহু করে কেঁদে উঠেন রাকিবের মা।

বাড়িতে থাকা শহিদ রাকিবের বাইক দেখিয়ে তার বাবা বলেন-‘প্রতিদিন এই বাইক আমি যতœ করে মুছে রাখি। বাইকটা হাত দিয়ে স্পর্শ করি। কখনো কান্নাকাটি করি। বাইকটা স্পর্শ করলে মনে হয়, আমার রাকিব বোধহয় আমার স্পর্শ টের পাচ্ছে।’

রাকিবের ব্যবহৃত ওয়াশিং মেশিন সযতেœ রেখে দিয়েছেন মা হাফিজা খাতুন। ঘুরে ফিরে তিনি ওয়াশিং মেশিনের কাছে যান। ছেলের হাতের স্পর্শ অনুভব করার চেষ্টা করেন। ছেলের ব্যবহৃত হেলমেট হাতে নিয়ে আনমনে বসে থাকেন মা হাফিজা খাতুন। অঝোরে চোখ বেয়ে ঝরে পড়ে অশ্রুধারা ।

রাকিবুলের বাবা বলেন, আমাদের ছেলেরা একটা সুন্দর, মানবিক, সহিষ্ণু ও বৈষম্যহীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন নিয়ে রাজপথে আত্মদান করেছে। সরকারের কাছে অনুরোধ, যারা শহিদ হয়েছে তাদের যেন এই দেশ এই জাতি ভুলে না যায়। ফ্যাসিস্ট সরকারের নির্যাতনে হাজার হাজার মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করেছে। রাষ্ট্র যেন তাদের দায়িত্ব নেয়। এত রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা যেন, মলিন না হয় সেই কামনা সরকার, রাষ্ট্র ও জাতির কাছে।

তিনি জানান, রাকিবের মৃত্যুর পর তার তারা বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)’র পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা ও জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ-এর পক্ষ থেকে ১ লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছেন। তবে সরকারিভাবে এখনও পর্যন্ত কোনো অনুদান তারা পাননি।