বাসস
  ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৫:৩৫
আপডেট : ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৬:৩৬

যখন তখন বাবার কবরের কাছে ছুটে গিয়ে কাঁদে ছোট্ট শিশু তানহা

॥ সেলিম আউয়াল ও শুয়াইবুল ইসলাম ॥

সিলেট, ২৪ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : পিচঢালা রাস্তার পাশেই বাড়ি, বাড়ির সামনে বাংলাদেশের একটি পতাকা উড়ছে। রাস্তা থেকে চলে যাওয়া ছোট্ট পথ দিয়ে কয়েক কদম হাঁটতেই ছোট্ট দুজন কন্যাশিশুর সাথে দেখা। মাটিতে বসে খুব মজা করে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে আর কিসব খেলছে। বললাম তাজউদ্দিন মিয়ার বাড়ি কোনটি? দুটো শিশুর একজন বললো, তাইন (তিনি) আমার আব্বা। মূহুর্তেই মেয়েটির চোখ জলের সরোবর হয়ে গেলো। শিশুটির নাম তানহা। পুরো নাম ঈশা জান্নাত তানহা। সে ক্লাস থ্রিতে পড়ে। আনন্দে মত্ত শিশুর চোখে হঠাৎ জল দেখে মনটা খারাপ হয়ে যায়। বললাম তোমাদের ঘরে যাবো, তানহা আমাদেরকে পথ দেখিয়ে তাদের ঘরে নিয়ে গেলো।

তাজ উদ্দিন মোটামুটি স্বচ্ছল একজন মানুষ। ব্যবসা করতেন। গোলাপগঞ্জ উপজেলা হেলথ কমপ্লেক্সের সামনে তার দোকান। তিনি হাসপাতালে বিভিন্ন মালপত্র সরবরাহ করতেন। তিন ভাই আর তিন বোনের মধ্যে তিনি সবার বড়ো। বাবা মকবুল আলী বেঁেচ নেই। মা সুফিয়া বেগম বেঁেচ আছেন ছেলের শোক বুকে চেপে। তাজউদ্দিনের বয়স চল্লিশ বছর। তার বাড়ি সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলার ঢাকাদক্ষিণ ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের বারকোট গ্রামে।

আমরা যখন তাজউদ্দিনের বাড়িতে পৌঁছি তখন বাড়িতে কোন পুরুষ ছিল না। সকলেই ছিলেন নারী। তারা হচ্ছেন তাজ উদ্দিনের মা সুফিয়া বেগম, তার স্ত্রী রুলি বেগম, বোন ফাতেমা বেগম, নাসিমা বেগম, হালিমা সাদিয়া এবং কন্যা ইশা জান্নাত তানহা, খাদিজা জান্নাত। তাজউদ্দিনের দুই ভাইয়ের মধ্যে এক ভাই পর্তুগালে আরেক ভাই বাহরাইনে থাকেন। ঘরের দেয়ালে ঝুলানো কাঁচের ফ্রেমে চমৎকার করে বাঁধাই করে তানহা, খাদিজার জন্ম তারিখ লেখা। তাজ উদ্দিনের ছোট কন্যা খাদিজার বয়স মাত্র তিন মাস, যে ‘বাবা’ ডাক দিতে পারেনি, যে কোনদিন তার বাবাকে পারবে না ‘বাবা’ বলে ডাকতে। বাবার নিরাপদ বুকে কোনদিন হবে না তার আশ্রয়।

তাজউদ্দিনের মা সুফিয়া বেগম কথা বলছিলেন পর্দার আড়াল থেকে। কাঁদছিলেন, গুছিয়ে কথা বলতে পারছিলেন না। তার অনেক কথার এক কথা, ছেলে তো হারালেন-এখন তার দুই অবুঝ নাতিনের কি হবে, তিনি আর দুনিয়াতে আছেনই ক’দিন। তার হয়ে কথা বলতে শুরু করেন তার মেয়ে ফাতেমা বেগম। বললেন তাজউদ্দিনকে হত্যা করা হয় ৪ আগস্ট বেলা দেড়টার দিকে। তখন পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুঁড়লে মিছিল থেকে অসংখ্য মানুষ তাদের বাড়িতে এসে ঢোকেন। এরমধ্যে কয়েকজন ছিলেন মারাত্মক আহত। শরীরের বিভিন্ন স্থানে তাদের গুলি লাগে। ফাতেমারা গামছা দিয়ে ক্ষতস্থান বাঁধলেও রক্ত থামানো যাচ্ছিলো না। বাড়ির বাচ্চারা ভয়ে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলে তাদেরকে অন্য একটি রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তাজউদ্দিনের মা আফসোস করে বলেন, ‘গুলি খেয়ে অসংখ্য মানুষ তাদের বাড়িতে আসলেও তার ছেলে আসতে পারেনি নিজের বাড়িতে।’

তাজউদ্দিনের গুলিবিদ্ধ হবার স্থানটি দেখিয়ে তার বোন ফাতেমা জানালেন বুকে লাগা গুলিটি বের হয়ে যায় পিঠ দিয়ে। আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন তাজউদ্দিনের কবর। আমরা যাচ্ছিলাম কবরের দিকে, তখন কোথা থেকে হাজির তাজ উদ্দিনের এক চাচাতো ভাই কুটি মিয়ার ছেলে নওশাদ। সাদিয়া আমাদের সাথে নওশাদকে দিয়ে বললেন, ভাই আপনারা অই কথাটা লিখবেন, আমার ভাইয়ের বাচ্চাদের ভবিষ্যতের জন্য যেন সরকারি কোনো সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়।

নওশাদও ৪ আগস্টের মিছিলে ছিলেন। তিনি বললেন, সেদিন গোলাপগঞ্জ থেকে ঢাকা দক্ষিণগামী রাস্তাটি ছিলো জনতার দখলে। এই রাস্তাটি তাজউদ্দিনের বাড়ির পাশ দিয়ে চলে গেছে। শত শত মানুষের সাথে তাজউদ্দিনও নেমে আসেন রাস্তায়। বেলা এগারোটার দিকে তিনি বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসেন। তখন রাস্তায় থাকা পুলিশের অস্ত্রের বিপরীতে তাদের ছিলো খালি হাত। কারো বা হাতে বাঁশ। মিছিলে- স্লোগানে প্রকম্পিত ছিলো পিচঢালা পথ। তখন পুলিশ মিছিলের মানুষগুলো লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। কিন্তু জনতা পথ ছাড়ে না। মিছিলের মানুষের সাথে স্লোগান তুলে ছুটছিলেন তাজউদ্দিন। তার বাড়ি ছেড়ে ৫০/৬০ ফুট দূরে যেতেই পুলিশের ছোঁড়া একটি গুলি এসে লাগে তাজউদ্দিনের বুকে। রাস্তার পাশে লুটিয়ে পড়েন তিনি, একজন পুলিশ লাথি দিয়ে তাকে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের ছোট্ট খালে। পুলিশ গুলিবিদ্ধ তাজউদ্দিনকে ফেলে সামনে চলে যায়। এরপর নওশাদরা তাজউদ্দিনের কাছে ছুটে আসেন।

বাড়ির পাশেই একটি মসজিদ সংলগ্ন গোরস্থানে কবর দেয়া হয়েছে শহিদ তাজউদ্দিনকে। আমরা কবরের দিকে হাঁটি। তাজউদ্দিনের বোন ফাতেমা  বলেছিলেন, দিনের বেলা হঠাৎ হঠাৎ পাওয়া যায় না তানহাকে। বাড়ির লোকজনের জানা হয়ে গেছে সে কোথায় যায়। দেখা যায় তানহা দাঁড়িয়ে আছে তার বাবার কবরের সামনে এবং চোখ বেয়ে ঝরছে জল।

বাবার অবর্তমানে ছোট্ট দুটি শিশুর ভবিষ্যত এখন অন্ধকার। প্রয়োজনীয় সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসলেই বদলে যেতে শিশু দুটির জীবন।