বাসস
  ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১০:২৮
আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৩৫

শহিদ শাকিলের বাবা মায়ের পাশে দাঁড়ানোর আর কেউ রইলো না

॥ মুহাম্মদ হেদায়েত উল্লাহ ॥

গাজীপুর, ২৮ অক্টোবর, ২০২৪ (বাসস) : মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ তৃতীয় বর্ষের মেধাবী ছাত্র শাকিল হোসেন বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। শাকিল ২৩ বছরের টগবগে তরুণ। টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই চালাতেন। এছাড়া ফ্রী ব্লাড ক্যাম্পিংসহ বেশ কিছু সামাজিক কাজে ব্যাস্ত থাকতেন। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও নিজ এলাকায় ছোট বড় সবার বিপদে দৌড়ে আসা সকলের প্রিয় মুখ ও অকৃত্রিম বন্ধু শাকিল। বিগত আট বছর আগে স্ট্রোকের পর প্যারালাইসড হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকা অসুস্থ মাকে শাকিল নিয়মিত নিজ হাতে খাইয়ে দিতেন। বড় তিন বোনের বিয়ে হওয়ার পর শাকিল সবসময় বাবা মায়ের বিপদ আপদে পাশে ছিলেন।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহিদ হয়েছেন শাকিল।  তার অসুস্থ মা একমাত্র ছেলেকে হারানোর শোকে এখন ঠিকমতো খেতেও পারছেন না। সারাক্ষণ শাকিলের জামাকাপড় বুকে জড়িয়ে শুধু আহাজারি করছেন আর বলছেন, ‘আমার শাকিলরে গুলি করে মাইরা ফালাইছে। আমার শাকিল আর ফিরা আইবেনাগো। এখন আমারে কে খাইয়ে দিবেগো?’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও ক্লিপে শাকিল হোসেনকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে সামনের সারিতে শ্লোগান দিতে দেখা গেছে। গত ১৮ জুলাই বিকাল ৪টার পর উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে শাকিল তার ফেসবুক আইডি থেকে লাইভ করেছিলো। পুলিশের টিয়ারশেল ও গুলি ছোঁড়ার দৃশ্য দেখা গেছে সেই লাইভে। তার কিছুক্ষণ পরই মোবাইলে শাকিলের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর সংবাদ পান বলে জানান শাকিলের বাবা।
শহিদ শাকিল হোসেনের বাবা মো. বেলায়েত হোসেন বাসসকে জানান, ১৮ জুলাই লক্ষ্মীপুর জেলার গ্রামের বাড়িতে থাকাবস্থায় আসরের নামাজ পড়ে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর মোবাইল ফোনে আমার শাকিলের উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার সংবাদ পাই। ফোন করেছিলেন শাকিলের পরিচিত বড় ভাই ফুয়াদ আলম। তাঁর বাসাও টঙ্গীতে শাকিলদের এলাকাতেই।

ফুয়াদ আলম বাসসকে বলেন, শাকিল খুব ভালো ছেলে ছিলো। সে আমার এলাকার ছোট ভাই। আমরা এক সাথেই বড় হয়েছি। আমরা একসাথে ক্রিকেট, ফুটবল খেলতাম। শাকিল খেলাধুলায় ভালো ছিলো। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন থেকে শুরু করে সব আন্দোলন সংগ্রামে শাকিল সক্রিয় ছিলো। সমাজে সে ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিলো সবার কাছে। ঘটনার দিন উত্তরা বিএনএস সেন্টারের সামনে শাকিল পুলিশের গুলিতে আহত হওয়ার খবর পেয়ে দ্রুত উত্তরা মেডিকেল হাসপাতালে যাই। সেখানে গিয়ে শুনি চিকিৎসক শাকিলকে মৃত ঘোষণা করেছেন। আমি তখন শাকিলের বাবার মোবাইল নম্বরে তার মৃত্যুর সংবাদ জানাই।

শাকিলের পিতা বেলায়েত হোসেন জানান, টঙ্গীতে ও মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শাকিলের পৃথক তিনটা জানাযা শেষে পরদিন সকাল ৯টায় শাকিলের লাশ গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরের কাকিলাতলীতে পৌঁছায়। সেখানে সর্বশেষ জানাযা দিয়ে শাকিলের দাদা দাদীর কবরের পাশে দাফন করা হয়েছে।

শহীদ শাকিল হোসেনের পিতা মো. বেলায়েত হোসেন (৬৭) ও মাতা পারভীন আক্তার (৫২) বড় তিন মেয়েকে বিয়ে দেওয়ার পর একমাত্র ছোট ছেলেকে নিয়ে থাকতেন টঙ্গীর হোসেন মার্কেট বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনের বাচ্চু রোডের একটি ভাড়া বাসায়। দীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে এই এলাকায় বসবাস করে আসছেন তারা। শাকিলের জন্ম, পড়াশোনা এখানেই। স্থায়ী নিবাস লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার কাকিলাতলী গ্রামে। শাকিলের বড় বোন বিউটি আক্তার (৩৫) এর বিয়ে হয়েছে বরিশালের ছেলে মাইনউদ্দিনের সাথে। স্বামীর মুদি ব্যবসার সুবাদে তারা আশুলিয়ায় থাকেন। মেঝো বোন সুইটি আক্তারের (৩২) বিয়ে হয়েছে লক্ষ্মীপুরের রায়পুরে। তার স্বামী শাহীন কৃষি কাজ করেন। আরেক বোন নাদিয়া আক্তার (২৫) এর বিয়ে বরিশালের ছেলে মিজানুর রহমানের সাথে হয়েছে। তারাও বর্তমানে ঢাকার আশুলিয়ায় থাকেন।

শহিদ শাকিলের পিতা মো. বেলায়েত হোসেনের সাথে বাসস প্রতিনিধির কথা হয় টঙ্গীর এরশাদ নগর বড়বাজারে ছোট্ট একটি ক্রোকারিজের দোকানে। এলুমিনিয়ামের হাড়িপাতিল ও মাটির তৈরি তৈজসপত্র বিক্রি করেন তিনি। এই দোকানই তাঁর উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন।

তিনি বাসসকে কান্নাজড়িত কন্ঠে  বলেন, আমাদের বড় তিন মেয়ের পর শাকিল ছিলো আল্লাহর দেওয়া আমার জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার। মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর সংসার করছে। শাকিল সবসময় আমার ও তার মায়ের কাছে ছিলো। আমাদের দেখাশুনা করতো। এখন কে আমাদের দেখবে? কে আমাদের পাশে থাকবে?

তিনি আরো বলেন, পড়াশোনায় শাকিল খুব ভালো ছিলো। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো রেজল্ট করে মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ তৃতীয় বর্ষে পড়তো। তার শিক্ষকরা সবসময় প্রশংসা করতো। বলতো আপনার ছেলে খুব ভালো। আমার কলিজার টুকরা একমাত্র ছেলেটাকে ওরা কেড়ে নিয়েছে। ‘আমি এখন কী নিয়ে বাঁচবো’-এই বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। মানারাত বিশ্ববিদ্যালয়ে শাকিলের দুই বছরের জুনিয়র মাহফুজুর রহমান শুভ।

শুভ বলেন, ‘আমি দুই বছরের জুনিয়র হলেও শাকিল আর আমার মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিলো। বন্ধু হিসবে শাকিল একজন চমৎকার মানুষ ছিলো। কিছু মানুষ আছে না, যারা অন্যের বিপদের সময় নিজের কথা ভাবে না। শাকিল ঐরকম একজন মানুষ ছিলো। করোনার সময় আমার লাইফের সবচেয়ে খারাপ সময় গিয়েছিল। সেই সময় শাকিল টঙ্গী থেকে

প্রতি সপ্তাহে উত্তরায় এসে আমার খোঁজ খবর নিতো। আমি যখনই কোন বিপদে পড়েছি শাকিল আমার পাশে দাঁড়িয়েছে। আসলে শাকিলের মতো এমন অকৃত্রিম বন্ধু পাওয়া যায় না।
শুভ আরো বলেন, কলেজ জীবন থেকেই শাকিল টিউশনি করে নিজের পড়ালেখার বেশিরভাগ খরচ নিজেই চালাতো। বিপদে আপদে অনেক মানুষকে তার সাধ্যমত আর্থিক সহযোগিতা করতে দেখেছি। আমরা স্টুডেন্ট ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন ও ফ্রী ব্লাড ব্যাংকের সাথে যুক্ত ছিলাম। সে গাজীপুর ব্লাড ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ছিলো। কারো জরুরি রক্তের প্রয়োজন হলে শাকিলকে বলার পর যে কোন উপায়ে সে রক্ত যোগাড় করে দিতো। আসলে শাকিলের মতো বন্ধুর শূন্যতা কখনোই পূরণ হবে না।

শহিদ শাকিল হোসেনের পিতা বলেন, শুধু আমার ছেলের হত্যাকারী নয় এই আন্দোলনে সব হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার করতে হবে। এই শহিদদের রাষ্ট্রের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে।

সাংবাদিক মুশফিকুল ফজল আনসারির পক্ষ থেকে এক লক্ষ টাকা ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই বারে দুই লক্ষ টাকা অনুদান পেয়েছেন বলে শহিদ শাকিল হোসেনের পিতা মো. বেলায়েত হোসেন বাসসকে জানান।