শিরোনাম
॥ বরুন কুমার দাশ ॥
ঢাকা, ৩ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস) : হুজাইফা আকন্দ বাসায় বসে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শহিদদের ছবি আঁকছে। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই সে প্রতিদিন সময় পেলেই শহিদ আবু সাঈদ, মুগ্ধসহ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে বিভিন্ন শহিদের ছবি আঁকে। সাত বছর বয়সের হুজাইফা আজিমপুর লিটলস্ এঞ্জেলস স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। বাবার মৃত্যু কিছুতেই সে মেনে নিতে পারছে না। বারবার বাবার কথা বলে। বাবার শোকে সে কিছু খেতেও চায় না। সব সময় মন খারাপ করে থাকে। মাঝে মাঝে বাবার কথা মনে করে কাঁদতে শুরু করে। থেকে থেকে কেঁদেই চলে সে।
রাজধানীর পলাশিতে বাবার সরকারি কোয়ার্টারে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে এমন কথা জানান বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত কাপড় ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদের স্ত্রী শাহানাজ।
তিনি বলেন, ছেলেটার বয়স সাত বছর। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে সব সময় মন খারাপ করে থাকে। সময় পেলেই বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ছবি আঁকতে শুরু করে। কিছু খেতে চায় না, বাবার কথা মনে হলেই কান্না শুরু করে। ওর বাবা যে আল্লাহর দরবারে চলে গেছে, সেটা কোন ভাবেই মানতে চায় না। ছোট বাচ্চা বুঝতে চায় না। কি করবো ছেলেটাকে নিয়ে। আসলে ছেলেটার ভবিষ্যত নিয়ে আমি অনেক বেশি চিন্তিত। তার বাবা ব্যবসা করে যা আয় করেছে সবই সংসারের পেছনে খরচ করেছে। কিছুই রেখে যেতে পারেনি।
বাসসের এই প্রতিবেদকের বাসায় যাবার খবর শুনে আব্দুল ওয়াদুদের একমাত্র ছেলে হুজাইফা আকন্দ বাসার সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিল। প্রতিবেদক তার কাছে কেমন আছো জানতে চাইলে, সে প্রথমে কোন উত্তর না দিয়ে শুধু চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। পরে তাকে প্রশ্ন করা হয়, আব্বুর কথা খুব মনে পড়ছে? সে কিছু না বলে শুধু মাথা নেড়ে বলে ‘হু’। এর পরে সে আস্তে আস্তে বলে আব্বুতো আকাশে চলে গেছে। আমার আব্বু আকাশের তারা হয়ে গেছে। পরে সে রুমে নিয়ে গিয়ে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার প্রেক্ষিতে তার আঁকা ছবি দেখায়।
শাহানাজ বলেন, এত ছোট বয়সে ছেলেটা তার বাবাকে হারিয়েছে। আমার পিতা সরকারি চাকুরি করতেন। তিনিও অবসরে চলে গেছেন। আমি কোন চাকুরি করি না। বাবার সংসারে কত দিন থাকবো? ছেলেটাকে কি ভাবে পড়া লেখা শিখাবো? পড়ালেখা করাতে গেলে তো অনেক টাকা লাগবে। আমি সেই খরচের টাকা পাবো কোথায়? অল্প আয়ের সংসার ছিল আমাদের। কষ্ট করে কোন রকম ভাবে দিন পার করতাম। এখন ছেলেটার ভবিষ্যত কি হবে ?
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শাহানাজ বলেন, ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় আব্দুল ওয়াদুদ। সেদিন বিকেলে নামাজ পড়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিল। অনেক সময় চলে যাচ্ছে। আবার বাইরের পরিস্থিতিও ভালো যাচ্ছিল না। অনেক বেশি চিন্তা হচ্ছিল আমার। এর মধ্যে সে ফোন করে আমাকে বলে আমি মাগরিবের নামাজ পড়ে একবারে বাসায় আসবো। এই বলে সে ফোন কেটে দেয়।
তিনি বলেন, এর দুই থেকে তিন মিনিট পরে তার ফোন থেকে আবার ফোন আসে। ফোন রিসিভ করে অন্য ব্যক্তির কন্ঠ শুনতে পাই। তখন আমাকে সে বলে এই ফোন যার সে আপনার কে হয়? আমি কি হয়েছে জানতে চাইলে, সে বলে তার মাথায় গুলি লেগেছে। তারপর সে কি বলছে আমি আর শুনতে পাইনি। পরে আমার ভাইকে জানাই। ভাই সেখানে গিয়ে আমার স্বামীকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যায়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
শহিদ আব্দুল ওয়াদুদ ১৯৮৬ সালের ১ জানুয়ারি বরিশালের বাকেরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। নিউমার্কেট এলাকায় প্রিয়াঙ্গন শপিং সেন্টারে তার কাপড়ের দোকান ছিল। আব্দুল ওয়াদুদ দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্য তৃতীয় ছিলেন। বাবা তাহের আলী আকন্দ (৬৮) এবং মা মাজেদা বেগম (৬০)। আব্দুল ওয়াদুদ ও শাহানাজ ২০১৩ সালের ৭ জানুয়ারি পারিবারিক ভাবে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। ২০১৭ সালে একমাত্র পুত্র হুজাইফা আকন্দ জন্ম গ্রহণ করে। পলাশিতেই শশুরের সরকারি কোয়ার্টারেই স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে থাকতেন ওয়াদুদ।
শহিদ আব্দুল ওয়াদুদের স্ত্রী শাহানাজ বলেন, প্রথমে লাশ দিচ্ছিলো না, অনেক ঝামেলা করছিলো। পরে ২১ তারিখ আমাদের কাছে লাশ হস্তান্তর করে। ওইদিন বিকেলে বরিশালের বাকেরগঞ্জে নিয়ে স্থানীয় কবরস্থানে লাশ দাফন করি।
শাহানাজ বলেন, আমার স্বামী খুবই ভালো মানুষ ছিলেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তেন। আল্লাহর রাস্তায় থেকে চলতে চাইতেন। কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলেন না। খুব সাধারণ জীবন যাপন করতেন। কিন্তু আল্লাহ আমার কপালে সুখ লিখে রাখেনি। তাই স্বামীকে অসময়ে নিয়ে গেলেন।
নিহতদের শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়ে শাহানাজ বলেন, যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন, তাদের সবাইকে শহিদের মর্যাদা দিতে হবে। শুধু মুখে বললাম শহিদ, তা তো হয় না। রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে শহিদের মর্যাদা দিতে হবে।
শহিদ আব্দুল ওয়াদুদের শশুর সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারি আব্দুর রব জানান, মেয়েটার মাত্র ১২ বছর আগে বিয়ে দিলাম। নাতিটার মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আমার জামাইটা খুব ভালো মানুষ ছিল। আল্লাহর নিকট একটাই চাওয়া সে যেন জান্নাতবাসী হয়।
শহিদ আব্দুল ওয়াদুদের শ্যালক আব্দুর রহমান বলেন, আসলে সেদিনের অবস্থা ও কষ্টের কথা বলা খুবই কঠিন। বড় বোনটা সব সময় মন খারাপ করে থাকেন। ভাগিনা’র মুখের দিকে তাকাতে পারি না। আর কোন পরিবারকে যেন এমন সমস্যায় পড়তে না হয় আল্লাহর কাছে এই প্রার্থনা করি।
গত ১৯ জুলাই বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় নিউমার্কেট এলাকা ছিল রীতিমতো রণক্ষেত্র। সরকারের বিভিন্ন বাহিনী ও সরকার দলীয় ক্যাডারদের মারমুখী অবস্থানের কারণে প্রচুর হতাহতের ঘটনা ঘটে। ওইদিন বিকালে নিউমার্কেট থানার নীলক্ষেত এলাকায় পুলিশের গুলিতে ব্যবসায়ী আব্দুল ওয়াদুদ নিহত হন। এ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ১৩০ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করা হয়। নিহত ব্যবসায়ীর শ্যালক আব্দুর রহমান বাদী হয়ে গত ২১ আগস্ট নিউমার্কেট থানায় এ মামলা করেন।