শিরোনাম
॥ সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন ॥
ঢাকা, ৪ নভেম্বর, ২০২৪ (বাসস): প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ ফ্রিল্যান্সার মিরাজ গত ৫ আগস্ট বাসা থেকে বের হয়েছিলেন। আশায় বুক বেঁধে। তার ডেমরার বাসা থেকে। ভেবেছিলেন ফিরবেন খুশির বার্তা নিয়ে। দীর্ঘ ১৬ বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনের অবসান হবে। আনন্দ ভাগাভাগি করে নেবেন পরিবারের প্রিয়জনদের সাথে।
ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। খুশির বার্তা এলো ঠিকই। কিন্তু মিরাজ এলেন না ফিরে। চলে গেলেন না ফেরার দেশে, অকালে।
মিরাজ হোসেন (৩০) গত ৫ আগস্ট বিকেলে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছেন। স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন হলেও বিজয়ের আনন্দ উদযাপন করতে পারলেন না তিনি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, মিরাজ ছাত্রজীবন থেকেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। তিনি ২০১৮ সালে কোটা বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় এ বছর বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজপথের প্রতিবাদে অংশ নিতে একটুও দ্বিধা করেননি তিনি।
মিরাজের শোকাহত ছোট ভাই পাভেল হোসেন বাসসকে বলেন, ‘আমার ভাই (মিরাজ) ২০১৮ সালের কোটা বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছিলেন। আর এ বছর ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি রাজপথেই ছিলেন।’
আন্দোলনে নিজে যোগদান করার পাশাপাশি মিরাজ তার বন্ধুদেরও আন্দোলনে অংশগ্রহণের জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি ফেসবুক এবং ইউটিউবের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ব্যাপক প্রচারণা চালাতেন।
মিরাজের বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী শাওন আল মাহমুদ বাসসকে জানান, আন্দোলন চলাকালীন অন্যান্য দিনের মতো ৫ আগস্ট সকালেও মিরাজ তার সব বন্ধুদের ফোন করে যাত্রাবাড়ী এলাকার শনির আখড়া পয়েন্টে জড়ো হতে বলেন।
সেখানে তিনি নিজের টাকায় বন্ধুদের সবার জন্য জাতীয় পতাকা কিনে দেন এবং আওয়ামী লীগ সরকারের জারি করা কারফিউ ভেঙে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘোষিত ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে যোগ দিতে শাহবাগ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন।
শাওন বলেন, কাজলায় পৌঁছালে দেখতে পাই মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা থেকে পুলিশ নির্বিচারে গুলি ছুঁড়ছে।
তিনি আরো জানান, সে সময় যাত্রাবাড়ী থানার কাছে অনেক দূরের একটি ভবনের ছাদ থেকে কিছু লোককে বিক্ষোভকারীদের ওপর ¯œাইপার দিয়ে গুলি ছুঁড়তে দেখা যায়। ধারনা করা হয়, পুলিশ ওই গুলি ছুঁড়ছিলো।
তবে দুপুর দেড়টা থেকে দুপুর ২টার মধ্যে পুলিশকে থানার দিকে পিছিয়ে যেতে দেখা যায় এবং শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়ায় ওই ¯œাইপাররাও ছাদ থেকে নেমে যায়।
শাওন বলেন, যদিও শেখ হাসিনার পদত্যাগের খবরের বিষয়ে আমরা তখনও নিশ্চিত ছিলাম না, তবুও আমাদের কয়েকজন বন্ধু সেখান থেকেই বাড়ি ফিরে যেতে চায়। কিন্তু মিরাজ শাহবাগে যাওয়ার ব্যাপারে অটল ছিলো।
তিনি আরো বলেন, ‘মিরাজ সেদিন নির্ভীক ছিলো। যখন সবাই গুলি থেকে বাঁচতে নিজেদের লুকানোর চেষ্টা করছিল, মিরাজ তখনও পিছু হটেনি।’
শাওন বলেন, ‘বেলা পৌনে ৩ টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে পৌঁছানোর পরপরই স্টেশনের বাইরে থাকা পুলিশের গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। সে সময় হঠাৎ আমরা দেখতে পাই আমাদের পাশ দিয়ে গুলি ছুটে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে থানার উল্টো দিকে গেলাম। কিন্তু মিরাজ গুলি থেকে বাঁচার চেষ্টা করেনি।’
ওই সময় থানা ভবনের ছাদ থেকে পুলিশ কাউকে দেখলেই গুলি করছিল জানিয়ে তিনি বলেন, এ সময়ে মিরাজ গুলিবিদ্ধ হয়। তার বুকের ডান পাশে গুলি লাগে।
শাওন জানান, পরে তিনি ফোনে মিরাজের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলে এক রিকশাচালক ফোন রিসিভ করে মিরাজের গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানান এবং প্রথমে তাকে যাত্রাবাড়ীর একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যেতে বলেন।
পরে রিকশাচালক তাকে মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মিরাজকে মৃত ঘোষণা করেন।
সেদিন শহরের রাস্তা জুড়ে ছিল ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। তাই মিরাজের পরিবারের কেউ হাসপাতালে পৌঁছাতে পারেনি। সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে শাওনকেই হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ গ্রহণ করতে হয়।
পুলিশের একটি মাত্র ঘাতক বুলেট ফ্রিল্যান্সিংয়ের একজন উদীয়মান তারকা মিরাজের জীবন প্রবাহ স্তব্ধ করে দিলো। এ স্তব্ধতা মেনে নিতে পারছে না তার পরিবার। তারা এখনও শোকের সাগরে ভাসছে।
তার গাড়ি চালক পিতা আব্দুর রব স্বল্প আয়ে সংসার চালাতে প্রায়ই হিমশিম খেতেন। বাবার এই জীবন সংগ্রামে সহায়ক হিসেবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন মিরাজ। আজ মিরাজ নেই। পিতার পাশে কে দাঁড়াবে এই ভেবে দিশেহারা পাভেল।
মিরাজের ভাই পাভেল আবেগঘন কন্ঠে বলেন, ‘আমার ভাইয়ের উপার্জনের টাকায়ই মূলত আমাদের সংসার চলতো।’ তাদের একমাত্র বোনের অনেক আগেই বিয়ে হয়ে গেছে। এখন বাবা এবং মাসহ তাদের তিন সদস্যের একটি পরিবার। কিন্তু মিরাজের মৃত্যুর পর তার বাবা আবদুর রব ও মা মমতাজ বেগম এখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেননি।
সরেজমিনে মিরাজের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, তাদের বাড়ির বসার ঘরে চেয়ার ল্যাপটপসহ তার ব্যবহৃত সব জিনিসপত্র তেমনই আছে। তার ল্যাপটপটি তখনও খোলা এবং পাশেই ব্লুট্রুথ সংযোগটি রাখা আছে। টেবিলের ডানপাশে তার ব্যবহৃত চশমা এবং ঘড়ি যেন তারই অপেক্ষায়।
টেবিলে আন্দোলনে তার অংশগ্রহণের একটি ছবি এবং শহীদ হওয়ার পর তার পরিবারকে দেওয়া একটি স্মারকও ছিল।
চেয়ার, টেবিল ও কম্পিউটার নিজ নিজ জায়গায় রয়ে গেলেও যিনি এসব ব্যবহার করতেন তিনি এখন কেবলই স্মৃতি। যা তার পরিবারের জন্য বড়ো ধরনের এক স্থায়ী শূন্যতা সৃষ্টি করেছে।
মিরাজের ব্যবহৃত জিনিসপত্র এবং তার রক্তমাখা শার্ট দেখাতে গিয়ে মিরাজের বাবা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। তিনি এক জায়গাতেই এগুলোকে রেখে দিয়েছেন। এতে তিনি মিরাজের উপস্থিতি অনুভব করেন। তিনি বলেন, ‘ছেলের স্মৃতি মনে করে আমি ও আমার স্ত্রী এসব ধরে কান্নাকাটি করি।’
আমার ছেলে ছিলো আমার বন্ধুর মতো। আমি আমার ছেলের স্মৃতি কি করে ভুলি? আমি কিভাবে ভুলি যে আমি যখন কাজলা এলাকার অন্য আহতদের হাসপাতালে যেতে সাহায্য করছিলাম, তখন আমার ছেলে বুকে বুলেট নিয়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে শুয়ে ছিল?’ একথা বলেই কান্নায় ভেঙে পড়েন আব্দুর রব।
তিনি অশ্রুরুদ্ধ কন্ঠে বলেন, গত ৫ আগস্ট সকালে মিরাজ দুইটি পরটা এবং ডিমের মামলেট দিয়ে নাস্তা করেছিলো। নাস্তা করার পর সকাল ৮টার দিকে সে আন্দোলনে যোগ দিতে যায়। কে জানত এটাই হবে তার শেষ খাওয়া?
মিরাজ বলতো,‘রিকশাচালকরাও আন্দোলনে নেমেছে। আর আমাদের ঘরে বসে থাকার সুযোগ কোথায়? আমরা দেশকে মুক্ত করব এবং দেশের জনগণকে ভালো রাখার জন্য দেশকে আবার স্বাধীন করব’।
রব বলেন, মিরাজ সব সময় দেশ ও জনগণের কল্যাণের কথা চিন্তা করতো এবং সে ছিলো পরোপকারী।
মিরাজের স্বপ্ন ছিল বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের জন্য কাজ করার। কিন্তু একটি গুলিতে তার সে স্বপ্ন ধুলিস্যাৎ হয়ে গেছে।
মিরাজের মৃত্যুতে তার বাবা রব এখনও শোকগ্রস্ত। শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রব কাঁদতে কাঁদতে বাসসকে বলেন, ‘আমি এখনও কাজ করতে পারি না। আমি কোথাও শান্তি পাই না। আমার ছেলের স্মৃতি আমাকে সারাক্ষণ তাড়িয়ে বেড়ায়।’
বিপ্লবে শহিদদের বিষয়ে তিনি বলেন, ছাত্র সমন্বয়কদের কাছে বিশেষ করে ৫ আগস্টে নিহতদের কোনো তালিকা নাও থাকতে পারে। চট্টগ্রাম রোড, সাইনবোর্ড, শনির আখড়া, রায়েরবাগ ও যাত্রাবাড়ী এলাকায় যারা নিহত হয়েছেন, শহিদের তালিকায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। ।
রব বলেন, ‘আমাকে সারা দেশ দিলেও আমি শান্তি পাব না। আমরা যখন শহিদদের তালিকায় আমাদের ছেলেদের নাম দেখতে পাব, তখন আমাদের হৃদয়ে শান্তি আসবে।’
তিনি আহতদের তালিকা তৈরি করার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এতে সবাই তাদের পাশে দাঁড়াতে এবং গণহত্যার বিচার দাবি করতে পারবে ।
তিনি বলেন, ‘পুলিশকে মানুষ হত্যার নির্দেশ দেওয়াসহ গণহত্যার জন্য দায়ী সকল ব্যক্তিকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনতে হবে।’
বড় ভাইয়ের সাথে স্মৃতিচারণ করে মিরাজের ছোট ভাই পাভেল বলেন, ‘আমরা কখনই একে অপরকে ছাড়া ঘুমাইনি। আমি এখন ঘুমাতে গেলে আমার ভাইকে খুব মিস করি।’
তিনি বলেন, ‘আমি ভাবতে পারি না, মিরাজ আর আমাদের মাঝে নেই। কখনই আমাদের কাছে আসবে না।’